thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

শেখ হাসিনার জন্যই বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন

২০১৭ জুন ১৭ ২১:২৬:৪৫
শেখ হাসিনার জন্যই বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের ৭১তম জন্মদিন ছিল ১৪ জুন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এই দিনে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে ১৭ হাজার গেরিলা যোদ্ধা তৈরি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গূরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার একমাত্র বেসামরিক যোদ্ধা হিসেবে কাদের সিদ্দিকীকে বীরউত্তম খেতাব ও বঙ্গবীর উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকের গুলিতে নিহত হলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। ১৬ বছর ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করে কাদের সিদ্দিকী ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু দলের সাথে নানান বিষয়ে মতবিরোধের কারণে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন কাদের সিদ্দিকী। বর্তমানে তিনি এই দলের সভাপতি। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে কাদের সিদ্দিকী সম্প্রতি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক সাগর আনোয়ার।

প্রশ্ন : ৭১ বছরে পদার্পণ করলেন। এই দীর্ঘজীবনে এসে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কাদের সিদ্দিকী : আসলে মানুষের জীবনে বয়স গুরুত্বপূর্ণ নয়। যিনি জীবন দিয়েছেন তিনিই জীবন নেবেন। জন্মেছিলাম ব্রিটিশে, বড় হয়েছি পাকিস্তানে আর এখন বাংলাদেশে। কখনও কখনও ভালো লাগে আমি এদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এদেশটা যদি আরেকটু ভালো থাকতো তাহলে শান্তি পেতাম। ভাবতাম যে দেশটাকে বানিয়েছি সে দেশটা ভালো আছে। যতো কষ্টই হোক স্বীকার করতেই হবে আমরা খুব একটা ভালো নেই। সবই আছে কিন্তু আমরা ভালো নেই। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সমস্ত কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে গেছে। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে আমাদের দেশের থেকেও বড় বড় পাহাড় আছে তাদের দেশে পাহাড়ে ধস নামে না। তারা পরিকল্পিতভাবে চলে, আমরা অপরিকল্পিতভাবে চলি। আমাদের দেশে রাস্তায় মানুষের চেয়ে গাড়ি বেশি। কিন্তু কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চালক তৈরি না করেই গাড়ি আমাদানি করি। আমরা কোনো কিছু ভালোভাবে না শিখেই তার উপর কর্তৃত্ব করতে চাই। আল্লাহ দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন, সুস্বাস্থ্য দিয়েছেন এজন্য আল্লাহর কাছে শত কোটি শুকরিয়া। আমি সারাজীবন মনে করতাম বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আমার শ্বাস। তিনি মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চলে গেছেন। তাই আমার এই বয়স উপরি পাওনা মনে হয়। দেশের জন্য কাজে লাগতে পারলে আরো ভালো হতো। ব্যক্তিগতভাবে সুস্বাস্থ্যে আছি, ভালো আছি। কিন্তু মানুষের কষ্ট আমাকে প্রচণ্ডভাবে পীড়া দেয়। সব সময় সেই পীড়া থেকে পথ খুঁজি। কবে পথ খুঁজে পাবো জানি না। কিন্তু মানুষ দারুণ কষ্টে আছে। কারো কাছে অভিযোগ করার, আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই। এটাই আজ দেশের জন্য বড় দুশ্চিন্তা।

প্রশ্ন : একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

কাদের সিদ্দিকী : আসলে গণতান্ত্রিক সমাজ থাকলে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া। আমরা গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র কলুষিত হোক আর নিষ্কলুষ হোক গণতন্ত্রের মধ্যেই আমরা আছি। সেটা ভালো হলে আমরা ভালো থাকবো। খারাপ হলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। আমার মনে হয় এই ভূখণ্ডে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এতো প্রয়োজন যেটা এর আগে আর কখনো হয়নি। একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য। উনি নিশ্চয়ই আজকে দেশের সব থেকে ক্ষমতাবান নেতা। জাতির চাইতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার ছোটাছুটি অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও বলবো তিনি যদি একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে উতরে যেতে পারেন তাহলে ভাবিকালে একজন গর্বিত নেতা হিসেবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইতিহাসে নন্দিত স্থান পাবেন। আর জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকলে যতোক্ষণ থাকবেন ততোক্ষণ নেতা। যে মূহূর্তে কর্তৃত্ব চলে যাবে সেই মূহূর্তে পথের কাঙাল। অনেকটা নবাব সিরাজউদ্দৌলার মতো। তাই নির্বাচন যেমন জাতির জন্য প্রয়োজন, মানুষ যে দেশের মালিক, এই মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন; তেমনি জননেত্রী শেখ হাসিরা নেতৃত্ব ও ভবিষ্যতের জন্যও প্রয়োজন।

প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হলে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আপনারা বার বার প্রশ্ন তোলেন। এবার নির্বাচনও যদি প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই হয় তাহলে?

কাদের সিদ্দিকী : নির্বাচন কারো অধীনে নয়। নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু পরিচালনায় হওয়া প্রয়োজন। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করে শেখ হাসিনা যদি প্রকৃত অর্থেও জয়ী হোন- অবিশ্বাসের এই জামানায় মানুষকে যদি বিশ্বাস অর্জন করাতে না পারেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে তিনি ক্ষমতায় যেতে পারবেন কিন্তু সফলতা পাবেন না। তাই এটা তাকে ভেবে দেখতে হবে। ন্যাড়া তো বেলতলাতে একবারই যায়। বার বার যায় না।

প্রশ্ন : আপনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হওয়ায় সেই নির্বাচনে আপনি অংশ নেননি। এবার হলে আপনি আপনি অংশ নেবেন?

কাদের সিদ্দিকী : এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি।

প্রশ্ন : বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? তাদের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু?

কাদের সিদ্দিকী : আসলে সময়ের আগে কথা বলা ঠিক না। তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক কথা নয়। এই কমিশন ব্যর্থ এটা যেমন বলা যাবে না। নারায়ণগঞ্জ বা কুমিল্লা নির্বাচন করে অনেক কিছু করে ফেলছে তাও তেমন ঠিক নয়। কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও দেখেছি- সেখানে কোনো নির্বাচনই হয়নি। রিটার্নিং অফিসার বা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কোনো নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব নেই। সরকারি দল পুলিশের সাথে বোঝাপড়া করে সব করে ফেলে। এসব প্রতিরোধে গণজাগরণ দরকার। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।

প্রশ্ন : নির্বাচন এলেই দুই বৃহৎ জোটের বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক জোটের সৃষ্টি হয়। এবারও নির্বাচনের আগে তেমনটার সম্ভাবনা কতটুকু?

কাদের সিদ্দিকী : নির্বাচনের সময় জোট হওয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। সব সময় হয়েছে-হয়-হবে। মূলকথা এটা কতোটা কার্যকরী। কে, কখন করতে পারে এটাই বড় কথা। দুই বড় জোটের বাইরে আলাদা পথ-ঘাটের সন্ধান মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাই নিশ্চয়ই হতেই পারে।

প্রশ্ন : দুই জোটের বাইরে বিকল্প জোট সফলতা পায় না কেন?

কাদের সিদ্দিকী : এটাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জন্মের পরে মৃত্যুর মতই। রাজনৈতিক সফলতা জ্যামিতিক বা পার্টিগণিতের হিসেব নয়। রাজনীতির যোগফল সব সময় একরকম হয় না।

প্রশ্ন : সরকারের এই মূহূর্তে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

কাদের সিদ্দিকী : অনেক টাকার বাজেট হলেই ভালো বাজেট হবে তা নয়। বাংলাদেশের জন্মের পরই ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে বাজেট হয়েছিল। কিন্তু হাজার কোটির বাজেটেও মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বা জাতীয় উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। এটা সরকারের মেয়াদের শেষ পূর্ণ বাজেট। এই বাজেটে সরকারের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ অবসরভোগীরা ব্যাংকে টাকা রেখে জীবনযাপন করেন সেখানে যেভাবে অর্থমন্ত্রী ছুড়ি চালিয়েছেন মানুষের কলিজা টুকরো টুকরো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো বাজেট পাশের সময় অনেককিছু কাটছাট করবেন সেটাই নিয়ম। কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। সরকারি দলের এমপিই সংসদে বলেছেন, এই বাজেটের কারণে ৯০ শতাংশ ভোটার নষ্ট হয়েছে। নিজেদের দলের সংসদ সদস্যরা যদি এমন মন্তব্য করেন তাহলে বিরোধীরা কি বলবে?

প্রশ্ন : নির্বাচন আসলেই বিদেশী রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের ছুটাছুটি বেড়ে যায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিদেশি প্রভাব ছিল স্পষ্ট। এবার নির্বাচনেও বিদেশি প্রভাবের সম্ভাবনা কতটুকু?

কাদের সিদ্দিকী : নির্বাচন আমাদের। ভালো মন্দ আমাদের। পর্দা বড় মারাত্মক জিনিস। একবার কেউ বেপর্দা হলে তার আর পর্দার প্রয়োজন পড়ে না। উলঙ্গের কোনো লজ্জা থাকে না। আমাদের উপর বিদেশিরা যেভাবে প্রভাব খাটায় এটা বড় লজ্জার। নিশ্চয়ই সীমার মধ্যে থেকে বন্ধুরা আমাদের সাহায্য, পরামর্শ দিতেই পারেন। বেপর্দা হয়ে নয়। চোর চুরি করে গোপনে। যে যখন প্রকাশ্যে আসে সে আর তখন চোর থাকে না। ডাকাত হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রেও পরামর্শক ও সাহায্যকারীরা বড় সামনে এসে যায়।

প্রশ্ন : হঠাৎ করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে খুব একটা আলোচনা দৃশ্যমান নেই... কারণ কি?

কাদের সিদ্দিকী : আসলে আমাদের দেশে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই অবশ্যই বিচার করা দরকার। এবং সেটা না হলে স্বাধীনতান জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন সেই শহীদানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আমাদের এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আন্তরিকতার সাথে হচ্ছে না। নানা সময় নানা সুযোগ সুবিধার জন্য পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত।

(দ্য রিপোর্ট/সাআ/এপি/জুন ১৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর