thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

আশুরা : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়-শেষ

২০১৮ সেপ্টেম্বর ২২ ১৪:১৮:২০
আশুরা : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়-শেষ

মাহফূজ আল-হামিদ

(পূর্ব প্রকাশের পর) আশুরায় বর্জনীয়:

বর্তমানে আশুরাকে ঘিরে অনেক কু-সংস্কার ও মারাত্মক অনৈসলামিক কাজকর্ম করা হয়। তার মাঝে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‍্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো হল, তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।

তাযিয়া কাকে বলে?

অভিধানে তাযিয়া বলা হয় বিপদগ্রস্ত লোককে শান্তনা দেওয়াকে। শরীয়তের পরিভাষায় তাযিয়া হল কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিন পর্যন্ত শোক পালন করা। বর্তমানে তা’জিয়া রুপ হল- ইমাম হুসাইনের রওজার মত করে এক রওজা তৈরী করা, সেখানে লাল চাদর দেওয়া, মোমবাতি-আগরবাতি, গোলাপজল, বিভিন্ন মিষ্টি প্রাসাদ ইত্যাদি দেওয়া, কালো কাপড় পরিধান করা, এই মাসে বিয়ে-শাদী না করা, শোক গাঁথা কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করা, মিথ্যা ঘটনাপুঞ্জী বর্ণনা করা, কৃত্রিম সমাধি তৈরী করা এবং নারী-পুরুষ ছোট-বড় সকলেই বরকতের জন্য একে স্পর্শ করা আর এর নীচ দিয়ে আসা-যাওয়া করা। ধারণা করা হয়, এতে বয়স বৃদ্ধি পায়, বিপদ দূর হয়। হুসাইন (রা.) -এর কথা স্বরণ করে হায় হুসাইন, হায় হুসাইন বলে গাল আর বুক চাপড়ানো। তাঁর কাছে নিজের ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা। মানুষ নিজ হাতে একটা কবর তৈরী করে তার কাছেই কি ভাবে প্রার্থনা করতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বলেন اتعبدون ما تنحتون ؟ তোমরা কি তার ইবাদত করো? যাকে তোমরা নিজ হাতে তৈরী করেছো? যারা এরূপ করে, তারা কিন্তু সওয়াবের উদ্দেশ্যেই করে থাকে। এই দিনে রোজা রাখার কথা স্পষ্ট সহীহ হাদীসে বিদ্যমান যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যারা তা’যিয়া করেন তাদের অনেকেই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আমল রোজা রাখার কথা বেমালুম ভুলে যান। তাদের অনেকেই নিজেদেরকে আলী (রা.) -এর বিশেষ শিষ্য বলে জোর দাবি করেন। অথচ, রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.) -কে এই বলে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেছিলেন যে, যেখানে কবরকে শক্তভাবে তৈরি করতে দেখবে, তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে। কিন্তু শিয়ারা তার উল্টা কাজ করেও কীভাবে নিজেদেরকে আলী (রা.) এর শিষ্য বলে দাবি করে?

মুসলমানরা খুশির মাসে শোক পালন করে কেন?

এর জবাব সন্ধান করতে গেলে দেখা যায়, রাসুল (সা.) -এর আদরের নাতি [জান্নাতি যুবকদের নেতা হযরত হুসাইন (রা.)] -এর কারবালার প্রান্তরে নির্মম শাহাদত বরণের কথা। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। জান্নাত প্রত্যাশি প্রতিটি যুবকই তার নেতার এই নির্মম শাহাদাত দিবসে শোক পালন করতে আগ্রহী হবে এটাই স্বাভাবিক যদি কুরআন ও হাদীসের অনুমোদন পাওয়া যায়। কিন্তু নবী (সা.)-এর শিক্ষা তো এমন- ‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’ অন্য হাদীসে নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’ উম্মে হাবীবা (রা.) বলেন, لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلَاثِ لَيَالٍ إِلَّا عَلَى زَوْجٍ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি- যে মহিলা আখেরাত ও আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে তার জন্য বৈধ নয় যে, সে কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশি শোক পালন করে। কিন্তু তার স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে পারবে। (বুখারী-৫০২৪, মুসলিম-৩৭০৯, তিরমিযী-১১৯৬, নাসাঈ-৩৫৩৩, আবূ দাঊদ-২২৯৯, ইবনে মাজাহ-২০৮৬, বাইহাক্বী-১৫৯৩২, হিব্বান-৪৩০৪)

রাসূল (সা.) আমাদেরকে তিন দিনের বেশি শোক পালন করার অনুমতি দেননি। তাহলে? তাহলে কি আমরা কুরআন ও হাদীসের অনুসরণ করব? যার বিনিময়ে আমরা জান্নাতি হতে পারব এবং সেখানে হুসাইন (রা.) -এর নেতৃত্বে থাকতে পারব। নাকি কুরআন ও হাদীসের বিরোধী কাজ করে জাহান্নামী হব? যেখানে তার কোন সহযোগীতা আমরা পাওয়ার যোগ্যতা রাখব না?

মাতম যদি বৈধই হত তবে আরো যাদের শোকে মাতম করা উচিত?

কেউ যদি মাতম করতে চায়, তাহলে সর্বপ্রথম বিশ্বনবী জনাব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর জন্য মাতার করা উচিত। যাঁকে কাফেররা জীবনব্যাপী কত কষ্ট আর যন্ত্রনা দিল! এক সময় আপন মাতৃভুমি ছাড়তেও বাধ্য হলেন। পর্যায়ক্রমে আবূ বকর (রা.) যিনি ইসলামের প্রথম খলীফা, ওমর (রা.), যিনি মসজিদে ফজরের নামাজ আদাই করা অবস্থায় শহিদ হয়েছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৬/২৫৯। উসমান (রা.) যিনি ৩৫ হিজরীর ১৮ই জিলহাজ্ব নিজের বাসভবনে আততায়ী কর্তৃক নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। আলি (রা.), যিনি ৪০ চল্লিশ হিজরির ১৭ই রমজান শুক্রবার কুফার মসজিদে ফজরের নামাজের কিছুক্ষণ পর খারেজীদের দ্বারা নিয়োজিত আততায়ী আব্দুর রহমান ইবনে মালজুম এর বিষাক্ত ছুরি দ্বারা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। এর তিন দিন পর ৬৩ বৎসর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৬/২৫৯, ৮/২২১)। হাসান (রা.) ও অসংখ্য সাহাবী, যারা ওহুদ, বদর সহ বিভিন্ন যুদ্ধের ময়দানে কেবলমাত্র ইসলামের পতাকা উড্ডীন করতে অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কই? তাদের জন্য তো কাউকে মাতম করতে দেখা যায় না। তথাপি তা’যিয়া আর মাতম পালনকারী শিয়া স¤প্রদায়ের লোকেরা আবূ বকর ও ওমর (রা.) -কে কাফের বলে গালি দেয় (নাউজুবিল্লাহ)।

আশুরার শিক্ষা:

১. হজরত মুসা (আ.) ও ইবরাহিমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া:
আশুরার দিন হজরত মুসা (আ.)-এর বিজয়ের ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। তিনি যেভাবে আল্লাহর পথে অবিচল থেকে ফেরাউনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরও বাতিলের পথকে রুদ্ধ করে ইসলামের আলোয় আলোকিত সমাজ গঠনের প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা গড়তে হবে।

২. কারবালার বিরল দৃষ্টান্ত:
আল্লাহতায়ালা মহররম মাসের দশ তারিখকে কারবালার ঐতিহাসিক বিরল দৃষ্টান্তের জন্যও মনোনীত করেছেন। এ দিনে নবী দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারবর্গ যে আত্মত্যাগের মহা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অপূর্ব। হিজরি ৬০ সনে ও ইংরেজি ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দিনে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্মরণকালের মানব ইতিহাসের নির্মমতম হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে এদিন ফোরাতের কিনারে শাহাদতের পানি পান করেন। নীতি ও আদর্শের জন্য, সত্য ও ন্যায়ের জন্য অবলীলায় প্রাণ উত্সর্গ মানব ইতিহাসে সত্যিই বিরল। অপ্রতিরোধ্য বাতিল ও শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে তেজদীপ্ত ঈমানদারের দুর্বল প্রতিরোধের যে ইতিহাস আশুরার দিনে কারবালা প্রান্তরে রচিত হয়েছে, তা অনন্য ও কালজয়ী। যুগ যুগ ধরে এ ঘটনা মানুষকে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রত্যয়ী হওয়ার প্রেরণা জোগায়।

আশুরার দিন কারবালা প্রান্তরে মানবেতিহাসের যে নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছিল তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের মজবুত ঈমান। তাই আমাদের ঈমানি চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে। কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে আত্মত্যাগ করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যে মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে সে মস্তক কখনও বাতিল শক্তির কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শপথ নিতে পারলেই কেবল আশুরার তাৎপর্য্য প্রতিফলিত হবে।

লেখক:প্রিন্সিপাল, আল-ইত্তেহাদ আন্তর্জাতিক মাদরাসা,বনশ্রী আবাসিক এলাকা, মৌলভীবাজার

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২২,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর