thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বর্তমান বাংলাদেশ

২০১৩ ডিসেম্বর ১৪ ০০:০১:৪৩
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বর্তমান বাংলাদেশ

ওয়াহিদ সুজন

সংবাদ মাধ্যমে বরাবরের মতো একই দৃশ্যের পুনরুৎপাদন দেখলাম। যদিও ইতিহাসে একই দৃশ্যের পুনরুৎপাদন মানে গুণগতভাবে নতুন কোনো ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হওয়া। সেটা ইতিবাচক না নেতিবাচক তার মূল্যায়নও করা যায়। তবে এই হাজিরানা ওই স্থান-কালের মানুষ বুঝতে পারুক আর না-ই পারুক কিছু পরিবর্তন তো ঘটে। সেই পরিবর্তন নির্দিষ্ট একটি সময়ের আয়নাও। যে দৃশ্যের কথা বলছিলাম- আবার ১৪ ডিসেম্বর চলে এল। সেই দিনকে উদ্দেশ্য করে মিরপুরের জাতীয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ধোয়া মোছার কাজ শেষ।

দৃশ্যের এই পুনরুৎপাদন বছরের পর বছর আমরা দেখে আসছি। একই সময়ে শহীদদের যন্ত্রণাকাতর আর্তি ও সমাজে তাদের অবদান কতটা আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে! নাকি শোককাতর হওয়ার আনন্দে আমরা শুধু বিগলিত হই!

পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশের ইতিহাসে এমন বিষাদময় ঘটনা নেই। প্রায় হাজার জন কীর্তিমান মানুষ নির্মমভাবে শহীদ হলেন। এই ঘটনা অনন্য কিন্তু বিষাদময়। এই বিষাদের ভার বাংলাদেশকেই বহন করতে হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীতাকে আমরা কতটা ইতিবাচকভাবে দেখছি।

আমরা বেশিরভাগই একে আদর্শিকভাবে দেখি। কারণ একটি জাতির সংকটের সঙ্গে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটও জড়িত। সেই সংকটের চিত্র আমরা মহাত্মা আহমদ ছফার ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে দারুণভাবে পাই। বইটি নানা কারণে আজো প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক বিপ্লবে যে ধরনের ভূমিকা রাখার কথা তা কি রাখতে পারছেন?তারচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বলতে আমরা কি বুঝি।

এই প্রসঙ্গে আমরা এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের ‘রিপ্রেজেন্টেশনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল’ থেকে কিছু বিষয় ধার করতে পারি-

বুদ্ধিজীবীদের আমরা মানব জাতির আদি ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি। ইতালীয় তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসিকে ধরলে আমরা সমাজে দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎ পাই। প্রথমত শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক ও প্রশাসকের মতো ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবী। অন্যদিকে আছে পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা, শিল্প প্রযুক্তিবিদ, রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন বৈধ ব্যবস্থার সংগঠক তৈরিতে যারা কাজ করে। অন্যদিকে জুলিয়ান বেন্দার মতে, এরা দার্শনিক রাজাদের ক্ষুদ্র দল, যারা মানব জাতির বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে।

এছাড়া এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ নিজে বলেন, বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি জনগণের প্রতি ও জনগণের জন্য সোচ্চার এবং মতামত, মনোভাব, দর্শন উপস্থাপন ও গ্রন্থিবদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর। আর সেই ব্যক্তি ছাড়া এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি লজ্জাজনক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম, যিনি সরকারি কিংবা কর্পোরেশনের সুবিধা পান না, যার raison detre অন্য সব লোকের সামনে তুলে ধরতে হয় এবং ইস্যুগুলো রুটিনমাফিক ভুলে যেতে হয়। বুদ্ধিজীবী সর্বজনীন নীতির উপর ভিত্তি করে এই কাজটি করেন।

তিনি আরো জানান, বুদ্ধিজীবী ছাড়া ইতিহাসে বড় কোনো বিপ্লব সংঘঠিত হয়নি। আবার বুদ্ধিজীবী ছাড়া বড় কোনো বিপ্লববিরোধী আন্দোলনও সংঘটিত হয়নি। এই অর্থে বুদ্ধিজীবী শব্দটিকে আমরা নৈতিক পদ আকারে হাজির করতে পারি। একই সঙ্গে এটি সামাজিক-রাজনৈতিক দায়ও বটে।

বিদ্যমান সমাজে বুদ্ধিজীবীর এই ইতি-নেতিবাচকতা নিয়ে আমরা সচেতন। সেদিক থেকে আমরা বুদ্ধিজীবীতাকে গড়পরতা জাতি গঠনের দিক থেকেই ভেবে থাকি। কিন্তু সেটা কতটা ব্যবহারিক বা প্রজ্ঞাপ্রসূত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখলে আহমদ ছফার একটি উক্তির কথা স্মরণ করা যায়। তিনি বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’

১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। এর পঁচিশ বছর পর ১৯৯৭ সালে প্রকাশ হয় একই বইয়ের পরিমার্জিত রূপ ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। এই দুই যুগের ব্যবধানে তিনি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একই বিষয় দেখতে পান।

সে বাস্তবতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো বিদ্যমান। এখানকার রাজনীতিকে দল মত বর্ণ নির্বিশেষে একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সক্ষমতা নিয়ে কোনো দলই হাজির হয় না। তাদের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অপরকে দমনের যে হিংস্র মানসিকতা আমরা দেখতে পাই- তা আসলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যেরই ফল। সেক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনো ব্যতিক্রম নয়।

প্রতিবছর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। সেই বিষাদ গাথা নিয়ে নানা কথা বলি। এবারও বলা হচ্ছে। কিন্তু চিন্তার দিক থেকে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলায় আমাদের মনোযোগ নেই। এর অন্যতম কারণ হলো জাতি গঠনের দিকে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনোযোগ নেই। বাংলাদেশের টেলিভিশন টক শো দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়। সেখানে অতিথিদের উপস্থিতির বিন্যাসও মজার। সাধারণত দুটি বিপরীত দলের পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা হাজির হন। তাদেরকে কোনো বিষয়ে একমত হতে দেখা যায় না। অন্যদিকে এই রকম দলবাজি না করলে অনুষ্ঠানও জমে না। দর্শক চ্যানেল পাল্টে দেয়।

এসব কথা বাদ দিলে, বুদ্ধিজীবীরা সব সময় জনগণের কাছে নন্দিত হবে এমন নয়। তাদের মধ্যে এক ধরনের সর্বজনীনবোধ কাজ করে। সেই বোধটিই একটি জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। সনাতনী ও খণ্ডিত মূল্যবোধকে অনেক সময় জনগণ উল্টেপাল্টে নাও দেখতে পারে। এটা তাদের দোষ-ত্রুটি নয়। বরং চলমানতার মধ্যে একই রুটিনে থাকা তাদেরই কাজ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর কাজ আরো গভীর। তারা তথাকথিত মূল্যবোধ ও খণ্ডিত চিন্তার বিপরীতে জাতির ইতিহাসকে নতুন সম্ভাবনা ও ইতিবাচকতার দিকে নিয়ে যাবেন।

বাংলাদেশের মতো আধাসামন্তীয় দেশে যেখানে কথিত গণতন্ত্রের বিশ বছর পার করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন বলতে তেমন কিছু ঘটেনি। গণতন্ত্রের সঙ্গে ব্যক্তি ও বুর্জোয়া বিকাশের যে সম্পর্ক সেটা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

আমরা এখনো চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে শিখিনি। এমন একটি দেশে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জনগণকে উপযুক্ত করে তুলতে হলে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সমাজের নানা স্তরের চিন্তা সক্রিয় হয়ে উঠবে। জনগণের জাগরণের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো হয়তো আমরা পেতে পারি। একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কটা হয়তো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীতার কোনো ইতিবাচক রূপ আমরা হয়তো দেখতে পাবো। গত চল্লিশের মধ্যে বর্তমানে সামাজিক বিভাজনগুলো আমাদের কাছে সাফ হয়ে উঠেছে। হয়তো অনেকে এরমধ্য থেকে আমাদের পথ দেখাতে পারবেন।

এটা তো সত্য- বাস্তব মোকাবেলা না করলে আমাদের পক্ষে সত্যকে হাসিল করা সম্ভব হবে না। এই বাস্তবতায় আমরা হয়তো ধীরে ধীরে পৌঁছে যাবো। হয়তো আগামীর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য হবে নতুন ইশারা। সে ইশারা দেখাবে ইতিবাচক বাংলাদেশ। সে দিনের প্রার্থনায় সকল শহীদদের প্রতি সালাম।

হদিস-

১. এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ, অনুবাদ : দেবাশীষ কুমার কুণ্ডু, রিপ্রেজেন্টেশনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল (ঢাকা : সংবেদ, ২০০৭)।

২. আহমদ ছফা, সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ (ঢাকা : খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ২০১১)।

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

মুক্তমত এর সর্বশেষ খবর

মুক্তমত - এর সব খবর