thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১,  ২৬ জমাদিউস সানি 1446

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আপাত সমঝোতার নেপথ্যে

২০১৩ ডিসেম্বর ২০ ০১:৫০:৩২
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আপাত সমঝোতার নেপথ্যে

শাহনেওয়াজ খান

সম্প্রতি ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির একটি আপাত সমঝোতা হয়েছে। আপাত বললাম এ কারণে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অদূর ভবিষ্যতে এ চুক্তির মূল্যায়ন করবে কিনা তা দেখার বিষয়। আর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা বলার কারণ, চুক্তিটি বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে হলেও মূলত তা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি- বর্তমান সময়ের মহাপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিলেও অবশেষে তা থেকে সরে এসেছে। এর আগে এর চেয়েও ঠুনকো অভিযোগে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালালেও ইরানের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় মনোভাব বিশ্ববাসীকে বেশ অবাকই করেছে। তবে এর পেছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণগুলোকে আমি দু’ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে চাই।

১. যেটা সকলেই কম-বেশি অনুধাবন করেছেন ও বলেছেন তা হলো অর্থনৈতিক কারণ। একে তো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ সুবিধাজনক স্থানে নেই, তার ওপর আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের ব্যয় বেশ সংকটেই ফেলেছে তাদের। এছাড়া সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের অর্থনৈতিক ও যুদ্ধাস্ত্র সাহায্য অব্যাহত থাকায় বেশ কিছুটা চাপও সামলাতে হচ্ছে তাদের। ঠিক এ মুহূর্তে ইরানের মতো দেশে হামলা দেশটির জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণই। সত্যি বলতে, দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল এ হামলাটি তাদের জন্য ঠিক কতটা সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক এ মুহূর্তে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে না। একই সঙ্গে মুরুব্বিয়ানাও বজায় রাখতে হয়! তাই এ সমঝোতা চুক্তি।

২. প্রথম কারণটি ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশের পক্ষে একক সামরিক যুদ্ধ চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তাই দেশটির সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে হলে চাই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান ও কূটনৈতিক কৌশল। ইরান বিষয়টি অনুধাবন করে ঠিক এ পথেই এগিয়েছে।

আগেই দেখিয়েছি যুক্তরাষ্ট্র ঠিক এ মুহূর্তে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এজন্য তারা ইরানের ওপর প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাদের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে এ অবরোধ আরোপ করলেও রাশিয়া, চীন বরাবরই এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের বাণিজ্য বন্ধ হলেও এ ব্লকটিতে তা বেশ ভালোভাবেই বজায় ছিল। এ কারণে ইরানকে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। কারণ, ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই দেশটি পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্য বেশ কমিয়ে এনেছিল।

তবে অবরোধ আরোপর বেশ কিছুদিন পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বেশ কমে যায়। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি বেশ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু, সকলকে চমকে দিয়ে এ অবস্থা থেকে উৎরে যায় দেশটি। রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি এ সময় আগমন ঘটে এশিয়ার আরেক পরাশক্তি ভারতের। অনেকটা রাজনৈতিকভাবে উল্টো মেরুতে অবস্থান করা দেশ দুটির মধ্যকার তেল চুক্তিতে বেশ অবাকই হয় বিশ্বশক্তিগুলো। পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরি ভারতকে এ চুক্তি থেকে সরে আসতে বললেও এতে সাড়া দেয়নি দেশটি। এ চুক্তির ফলে অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝেই অর্থনৈতিক সীমানা বাড়ায় ইরান। এছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দেশটির তেল বাণিজ্য আগে থেকেই চলে আসছে।

রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে এ চুক্তি বেশ গুরুত্ব বহন করে। এতে একটি প্রশ্ন স্বভাবতই দেখা দেয়- সত্যিই কি অবরোধ আরোপের ফলে তেলের মূল্য কমেছিল না ইচ্ছাকৃতভাবেই কমিয়েছিল ইরান? তেলের মূল্য হ্রাসের পরপরই কিন্তু ইরানের তেল বাণিজ্য আরেকটু চাঙ্গা ও বিস্তৃত হলো। কিছুদিন পর তেলের মূল্য কিন্তু ঠিকই আগের স্থানে ফিরে এসেছিল!

একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বর্তমান যুদ্ধের উদ্দেশ্য শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই নয়; উপরন্তু অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া। সেক্ষেত্রে বর্তমানে একক যুদ্ধ পরিচালনা বেশ অসাধ্যই। একজন লাভবান হবে, আর অন্য মোড়লরা তা তাকিয়ে দেখবে তা হতে পারে না। এজন্যই সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোতে ইউরোপীয় দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় মিত্ররা এগুলো থেকে লাভবান হলেও রাশিয়া ও চীন কিন্তু সরাসরি তা হয়নি। এ কারণে তারা প্রত্যেক যুদ্ধেই ভেটো দিয়েছে। এবার ইরান যখন তাদের কম মূল্যে তেল সরবরাহ করছে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য খামোখা তারা তা ত্যাগ করবে কেন? অল্পমূল্যে তেল পাওয়া যুদ্ধ করে তা কেড়ে নেওয়ার চেয়ে অধিক সুবিধাজনক। সুতরাং, এ সুযোগ কেন হাতছাড়া করবে তারা? তাই এবার শুধু ভেটো দানেই সীমাবদ্ধ না থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল দেশ দুটো। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক কারণেই রাশিয়াকে একটু জোরালো ভূমিকা রাখতে হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই মোড়লগিরির একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলে আসছে। এবার একটা যুৎসই প্লাটফর্মও পেয়ে গেল দেশটি। পাশাপাশি নতুন করে ভারত যোগ দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দেয়।

এ অবস্থায় মধ্যপন্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক আলোচনাকেই বেছে নেয়। শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের এ আলোচনার ফলে আপাতত একটা যুদ্ধ এড়াল বিশ্ব। তবে ইসরাইলের অসন্তুষ্টি ও ভ্রুকূটি কিছুটা অস্বস্তি রেখেই দিল। শক্তিশালী ইহুদি লবিকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উপেক্ষা করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

মুক্তমত এর সর্বশেষ খবর

মুক্তমত - এর সব খবর