thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

গাজীপুরে পাকবাহিনীর ওপর বাঙালিদের গুলি, ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের বৈঠক

২০১৬ মার্চ ১৯ ০০:২১:৫১
গাজীপুরে পাকবাহিনীর ওপর বাঙালিদের গুলি, ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের বৈঠক

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রথম অস্ত্র গর্জে উঠেছিল ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। এদিন গাজীপুরে (তৎকালীন জয়দেবপুর) জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠে। তখন গাজীপুরের ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ীতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল ‘দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এর। এ রেজিমেন্টের ২৫ থেকে ৩০ জন জওয়ান অফিসার ছাড়া অবশিষ্ট সকলেই ছিলেন বাঙালি ও বলাবাহুল্য এ বাঙালি অফিসাররা ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। সে সময় এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক (সিও) ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদ হাসান খান ও সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ। স্বাভাবিকভাবেই এ রেজিমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি অফিসারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও অবাঙালি সৈন্যরা মেনে নিতে পারছিল না। এমতাস্থায় বাঙালি সৈন্যদের দমিয়ে রাখতে তাদের নিরস্ত্র করার ফন্দি আঁটে শাসকগোষ্ঠী। এর অংশ হিসেবে বাঙালি সেনাদের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ১৫ মার্চের মধ্যে ঢাকার সদর দফতরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে এ রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং বাঙালি সেনাদের কেউই অস্ত্র ও গোলা-বারুদ জমা দিতে রাজি ছিলেন না। ফলে গাজীপুর থেকে অস্ত্র নিয়ে এ মুহূর্তে ঢাকায় যাওয়া নিরাপদ নয় বলে জানিয়ে দেন রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল মাসুদ। বলাবাহুল্য, তার এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পরবর্তীতে ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানি সৈন্য নিজেই ১৯ মার্চ গাজীপুরে আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যথারীতি এদিন তিনি গাজীপুর আসেনও।

এদিকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের গাজীপুরে আসার খবর আগে থেকেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার গাজীপুরে এসেছে— এ খবরে গাজীপুরের জনগণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং হাজার হাজার লোক জমায়েত হয় গাজীপুর বাজারে। সমরাস্ত্র কারখানা এবং বাংলাদেশ মেশিন-টুলস কারখানার শত শত শ্রমিক-কর্মচারীরাও এসে যোগ দেয় উত্তেজিত জনগণের সঙ্গে। এ সময় লাঠি, তীর, বল্লমসহ নানা ধরনের দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও বহু লোককে অংশ নিতে দেখা যায়। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ইট, কাঠ, পাথর দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। রেলস্টেশন থেকে একটি মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে এনে রেলক্রসিংয়ের উপর রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রেজিমেন্টে বাঙালি সেনাদের সতর্কতা এবং জনগণের এ ধরনের মারমুখী অবস্থানের খবর পেয়ে বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব। তবে ঢাকায় ফেরার পথে রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে জনতার বাধার সম্মুখীন হন তিনি। এ সময় তিনি রাস্তা ফাঁকা করার নির্দেশ দিলে বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বাঙালি সেনারা। গুলির শব্দে উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা সেদিন কোনো মতে ঢাকায় ফিরে আসে।

এ ঘটনা চলাকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ট্রাক টাঙ্গাইলে রেশন দিয়ে গাজীপুর ফিরছিল। ট্রাকটি গাজীপুর মসজিদের কাছে পৌঁছলে উত্তেজিত জনতা এটা আটকে ফেলে এবং বাঙালি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ট্রাকের বাঙালি সৈন্যরাও জনতার সঙ্গে যোগ দেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালিদের প্রথম গুলি বর্ষণের ঘটনা।

দ্রুত এ ঘটনার কথা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। গাজীপুর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে চান্দনা চৌরাস্তায় স্থানীয় জনগণ জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে এই শ্লোগান উঠেছিল যে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

পাকবাহিনী ঢাকায় ফেরার পথে টঙ্গী বোর্ড বাজারে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শতাধিক লোক মারা যায়। সন্ধ্যায় গাজীপুরে সান্ধ্য আইন জারি করে বহুলোককে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আর কেউ ফিরে আসেনি।

জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশর মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয় যে, তারা শক্তি প্রয়োগকে ভয় পায়। জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয়, তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।’

এদিন চট্টগ্রামে মওলানা ভাসানী বলেন, শেখ মুজিবুরের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

শিল্পী কারমরুল হাসানের পরিকল্পনা ও ডিজাইনে বাংলা স্টিকার ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’ প্রথম প্রকাশিত হয়।

এদিনও অনেকগুলো মিছিল শেখ মুজিবুরের বাসভবনে যায়। শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাব।’

ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের তৃতীয় দফা বৈঠক

এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তৃতীয় দফা একান্ত বৈঠক হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আগামীকাল আবার বৈঠক হবে। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আমাকে সাহায্য করবেন। আজ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় মিলিত হবেন।’

‘জয় বাংলা’ প্রসঙ্গে এক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, “আমি মুসলমান, ঘুম থেকে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করি, তারপরই আমি ‘জয় বাংলা’ বলি। মৃত্যুর সময়ও আমি আল্লাহর নাম নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে বিদায় নিতে চাই।”

সন্ধ্যায় উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক প্রেসিডেন্ট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ড. কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জে. পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। দুই ঘণ্টার এ আলোচনায় উভয় পক্ষের উপদেষ্টারা কী ফর্মুলার ভিত্তিতে আলোচনা হবে অর্থাৎ ‘টাইমস অব রেফারেন্স’ নির্ধারণ করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা, শওকত হায়াৎ খান ও মওলানা মুফতি মাহমুদ এদিন ঢাকায় আসেন।

ভুট্টোর আস্ফালন

করাচিতে পিপিপি নেতা জেড. এ ভুট্টো ক্ষমতার জন্য গণআন্দোলন শুরুর হুমকি দিয়ে বলেন, ক্ষমতার হিস্যা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। তিনি শক্তি প্রদর্শনে বাধ্য হবেন।

গ্রন্থনা : সোহেল রহমান

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/সা/মার্চ ১৯, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর