thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

একজন রিপোর্টার ও বিবেকের কাঠগড়া

২০১৬ অক্টোবর ১৪ ২২:৫৩:৫৪
একজন রিপোর্টার ও বিবেকের কাঠগড়া

একজন ডাক্তারের একটি সফল অপারেশন একজন মানুষকে নবজীবন দান করতে পারে। আবার ওই ডাক্তারেরই একটি ভুল অপারেশন একজন জীবিত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। ঠিক তেমনি গণমাধ্যমের একজন রিপোর্টারের প্রতিটি রিপোর্ট একেকটি অপারেশনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি রিপোর্ট শুধু একজন মানুষকে নয়, একটি জনগোষ্ঠী, একটি সংগঠন ও একটি জাতিকে নবজীবন দান করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন রিপোর্টারের একটি মাত্র রিপোর্ট গোটা বিশ্বে তোলপাড় ঘটিয়ে দিতে পারে। উইকিলিকস ও পানামা পেপার্সে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটি মাত্র রিপোর্টের কারণে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। অনেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের যেতে হচ্ছে জেলে। সুতরাং একজন রিপোর্টারের একটি রিপোর্টের গুরুত্ব এতটাই অপরিসীম যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি একটি ভুল রিপোর্টের কারণে খ্যাতিমান ব্যক্তির মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি জনগোষ্ঠী, বিলীন হয়ে যেতে পারে একটি সংগঠন ও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে একটি জাতি। আবার ভুল রিপোর্টের কারণে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। সুতরাং রিপোর্টের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা, তথ্যের সত্যতা যাচাই ও সাবধানতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।

একজন রিপোর্টার তার রিপোর্টের মাধ্যমে সকলকেই দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এমনকি ওই নির্দেশনার আলোকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। আর অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টের ক্ষেত্রে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট বিচারকের একটি রায়ের কাছাকাছি। কেননা ওই রিপোর্টই বলে দিচ্ছে কি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আর এ অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি কে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যও থাকে সেখানে। সুতরাং একজন রিপোর্টারের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বা ভুল সংশোধনের জন্য আদালতের কাঠগড়ার প্রয়োজন নেই। আইনকানুনের ফ্রেমে আটকিয়ে শাস্তির ভয় দেখানোর প্রয়োজন নেই। একজন রিপোর্টারের বিবেকই তার জন্য কাঠগড়া। ভুল সংশোধন করার জন্য একজন রিপোর্টারের বিবেকই তার জন্য যথেষ্ট। একটি ভুল রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ওই রিপোর্টারের বিবেক তাকে দংশন করবেই। প্রতিদিন রিপোর্টারকে পরীক্ষা দিতে হয়, প্রতিদিন পাঠকের সামনে হাজির হতে হয়। একটি ভুল রিপোর্টের কারণে শুধু রিপোর্টারই দায়ী হয় না, বরং সে দায় সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সম্পাদক, প্রকাশক ও মালিকের উপর গিয়েও বর্তায়। এমনকি রিপোর্টারের ভুলের কারণে সম্পাদককে জেল খাটতে হয়।

একজন রিপোর্টারকে দক্ষ ও নীতিবান হিসেবে গড়ে তুলতে প্রেস কাউন্সিল বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছে। রিপোর্টারের ভুল সংশোধনের জন্য তার বিবেককে শাণিত করতে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ বেশ সহায়ক। প্রত্যেক রিপোর্টারই একজন মানুষ। আর একজন মানুষ হিসেবে আমাদের ভুল-ভ্রান্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ জন্য জেল-জরিমানার প্রয়োজন হয় না। এ বিষয়টিই ভালোভাবে উপলব্ধি করানো হয়েছে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এ। এ আইনের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, ভুল রিপোর্টিং এর কারণে একজন রিপোর্টার ও একজন সম্পাদককে প্রকাশ্যে লজ্জা দেওয়ার শাস্তিই তাদের জন্য বড় শাস্তি। এ জন্যে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর ১২ ধারায় কাউন্সিলকে সতর্ক, ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদক সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করলে কাউন্সিল উক্ত সাংবাদিক বা সম্পাদককে সতর্ক, ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করতে পারবে। সেই সাথে কাউন্সিলের এ রায় সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রসহ যে কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশও করতে পারবে। প্রেস কাউন্সিল এ ধারা অনুযায়ী অসংখ্য পত্রিকার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। গত ২০১২ সালে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এর আবেদনের প্রেক্ষিতে মানহানিকর সংবাদ পরিবেশনের কারণে দৈনিক কালের কন্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, প্রকাশক মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিল রায় প্রদান করে। সেখানে তাদের সতর্ক করা হয়। প্রেস কাউন্সিলে এ ধরনের অসংখ্য রায় রয়েছে।

সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলা হয়। আমরা জাতিকে বিবেকের মতো দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকি। সে কারণে আমাদের বিবেক আরও শাণিত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। যাতে করে রিপোর্টে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা প্রকাশ পায়। অবশ্য আমাদের গণমাধ্যমগুলোর পলিসির কারণে সকল রিপোর্টে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবু বেশ কিছু নীতিমালা আমাদের মেনে চলা উচিত। তা না হলে যে কোনো সময় আমরা নিজেরাই বিপদের সম্মুখীন হতে পারি। আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে অনেক সহকর্মী রয়েছেন, যারা রিপোর্টের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। হয় চাকরি হারাচ্ছেন নতুবা মামলার শিকার হচ্ছেন। আমাদের সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ এর আলোকে একটি আচরণবিধি রয়েছে। এই আচরণবিধিটি ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সংবাদসংস্থা এবং সাংবাদিকের জন্য আচরণবিধি ১৯৯৩ (২০০২ সালে সংশোধিত)’ নামে পরিচিত। এই আচরণবিধিমালায় ২৫টি নির্দেশনা রয়েছে। তাতে সাংবাদিকদের নীতি নৈতিকতা ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা রয়েছে। সব ধারা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে এই বিধিমালা অনুযায়ী সাংবাদিককের জন্য একটি শপথনামাও রয়েছে। এই শপথনামায় ৯টি বিষয়ে শপথ পাঠ করতে হয়। তা হলো- ১) আমি দ্বিধাহীন সততার সঙ্গে সংবাদ এর প্রতিবেদন, ভাষ্য ও বিশ্লেষণ প্রণয়ন করবো ২) আমি স্বেচ্ছায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করবো না এবং সত্যকে বিকৃত করবো না ৩) আমি সর্বাবস্থায় সংবাদ উৎসের গোপনীয়তা রক্ষা করবো ৪) আমি সর্বাবস্থায় নিজের পেশাগত সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষা করবো ৫) আমি কখনো কারো কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করবো না অথবা বিচার বিবেচনাকে প্রভাবিত করতে পারে এরূপ ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রশ্রয় দেব না ৬) আমি সংবাদ, সংবাদচিত্র এবং দলিলাদি সংগ্রহে সর্বক্ষেত্রে সততা অবলম্বন করবো ৭) আমি জনসমক্ষে প্রকাশের জন্য কোনো সাক্ষাতকার গ্রহণের পূর্বে সাংবাদিক হিসেবে আত্মপরিচয় প্রদান করবো ৮) আমি দায়িত্বপালনকালে পেশাগত নৈতিকতা, সততা ও সম্মানবোধের প্রতি ব্রতী থাকবো ৯) আমি সাংবাদিকদের আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য থাকবো। এই শপথের নিচে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের স্বাক্ষর এবং সম্পাদকের স্বাক্ষর থাকে। আমরা অনেকেই এ শপথ পাঠ করি নাই। তবে এ শপথ পাঠ করে তার উপর অবিচল থাকলে সাংবাদিকতার মহান পেশার মহান মানুষের পরিণত হতে পারবো। এতে কোন সন্দেহ নেই।

মানহানি মামলা

সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে যে সকল মামলা হয়ে থাকে তার মধ্যে মানহানি মামলা অন্যতম। যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ওই ব্যক্তি মানহানি মামলা দায়ের করতে পারেন। তথ্য প্রমাণসহ রিপোর্ট করা হলে এ ধরনের মামলায় শেষ পর্যন্ত রিপোর্টারের পক্ষেই রায় আসে। তবে ভুল রিপোর্ট করা হলে সে ক্ষেত্রে খেসারত দেওয়া লাগতে পারে। মানাহানি মামলা ফৌজদারী আইনে করা যায় আর সিভিল আইনেও ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা যায়। এ সকল মামলায় সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের সাথে সম্পাদক ও প্রকাশককেও আসামি করা হয়ে থাকে। তবে মানহানির মামলায় আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আর আদালতও সমন দেওয়া ছাড়া প্রথমেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারবে না।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ আইনের ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। উক্ত আইনের বিধান অনুসারে কোনো মানুষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি কোনো কথা, প্রতীক বা দৃশ্যমান কোনো কিছু তৈরি করে বা প্রকাশ করে অপর মানুষের মানহানি ঘটান তবে তা মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে।

এ ছাড়া যদি কোনো মৃত মানুষের বিষয়ে মানহানিকর কোনো কিছু বললে বা প্রকাশ করলেও তা মানহানির অপরাধ হবে। এমনকি কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে মানহানিকর কিছু বললে বা প্রকাশ করলেও তা মানহানির অপরাধের পর্যায় পড়বে।

তবে মানহানিকর তখনি হবে যখন বক্তব্যটি বা প্রকাশনাটি সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে নৈতিক ভাবে হেয় করে বা তার চরিত্রকে নিচু করে। তবে মানহানির মামলাকে প্রতিহত করতে আলোচ্য আইনের ধারাতে ১০টি ব্যতিক্রম রয়েছে-১. বক্তব্যটি সত্য এবং জনস্বার্থে প্রকাশ করা বা বলা হয়েছে। ২.জনসেবকের আচরণ যখন সে জনদায়িত্ব পালন করছে। ৩. জনস্বার্থ জড়িত এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলে। ৪. আদালতের কোনো কার্যক্রমের ফলাফল প্রকাশ করা। ৫.কোনো মামলার মেরিট বা সাক্ষীদের আচরণ বর্ণনা করা। ৬. জন কার্যক্রমের ফলাফল বর্ণনা করলে। ৭. সরল বিশ্বাসে ভর্ৎসনা করা যখন ক্ষমতা থাকে ভর্ৎসনা করার। ৮. সরল বিশ্বাসে কারো বিরুদ্ধে নালিশ করলে। ৯. নিজের বা অপরের বা জনস্বার্থ রক্ষা করার জন্য বলা হলে। ১০. অপরের বা জনস্বার্থের ভালোর জন্য সতর্ক করলে।

দণ্ডবিধি আইনের ৫০০ ধারায় বলা হয়েছে যে, মানহানির জন্য ২ বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

এসব মামলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়ের করা হলে আদালত আসামিকে সমন দিয়ে তলব করে মামলাটি বিচার করতে পারেন। তবে এই মামলা জামিনযোগ্য এবং মীমাংসাযোগ্য। সুতরাং তথ্যপ্রমাণসহ রিপোর্ট করা হলে এ মামলাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আর তথ্য প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে অহেতুক রিপোর্ট করাও উচিত নয়।

বর্তমান সময়ে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের কারণে সবচেয়ে বেশি মানহানি মামলার শিকার হয়েছেন দি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তবে তার বিরুদ্ধে এসব মামলা ঢালাওভাবে রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে। অপরদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বিএফইউজে সভাপতি শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। তবে এ মামলাগুলোও রাজনৈতিক কারণে দায়ের করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রিপোর্টের কারণে আদালত অবমাননার মামলাও হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আদালত অবমাননার জন্য সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা। একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আদালত অবমাননার অভিযোগে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে ৬ মাসের সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করেছেন। আর সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমান ১ মাসের সাজা ভোগ করেছেন। সুতরাং রিপোর্ট করার সময় এমন কোনো বিষয় রিপোর্টে প্রবেশ করানো উচিত হবে না, যা আদালত অবমাননা হতে পারে।//////////

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা

বর্তমানে প্রত্যেক সংবাদপত্রেরই ওয়েব সাইট রয়েছে। আমরা পত্রিকার জন্য যেই রিপোর্টটি করে থাকি সেটি আবার ওয়েব সাইটেও প্রকাশ হয়ে থাকে। ওয়েব সাইটে প্রকাশিত মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্যের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) এর ৫৭ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে এ আইনের অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এ আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য মারাত্মক ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা। এ রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার কারণে দণ্ডবিধির ৪৯৯ বা ৫০০ ধারায় মানহানি মামলা হতো বর্তমানে সে মামলা অত্র আইনের ৫৭ ধারায় করা হচ্ছে। সংবাদপত্রের রিপোর্টটি ওয়েব সাইটেও প্রকাশিত হওয়ার কারণে এ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া যাচ্ছে। এ আইনটি নিয়ে অনেক বির্তক হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে। তবু এ আইনকে শিথিল করা হয়নি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ সংশোধন ২০১৩ এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে -

‘৫৭৷ (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷

(২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

অত্র আইনে মামলা জামিন অযোগ্য। এই মামলার বিচার হয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল নামক বিশেষ আদালতে। বর্তমানে এ আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। তার মধ্যে দৈনিক ইনকিলাবের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে রাতে অফিস চলাকালীন সময় পুলিশ পত্রিকা অফিসে অভিযান চালিয়ে বার্তা সম্পাদকসহ কয়েকজন সাংবাদিককে আটক করে এবং কম্পিউটার জব্দ করে। সেই সাথে প্রেসে সিলগালা করে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। পরে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী ওয়ারী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় আসামী করা হয় দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক ও প্রকাশক এএমএম বাহাউদ্দীন, প্রধান বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবি, ভারপ্রাপ্ত চিফ রিপোর্টার রফিক মোহাম্মদ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক আতিকুর রহমানকে। বর্তমানে মামলাটি এখনো চলমান রয়েছে। সাধারণত পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলে এভাবে মামলা করার কোনো নজির নেই। পত্রিকার রিপোর্টের কারণে মামলা করতে হলে আগে প্রতিবাদ দিতে হয়। তারপর আদালতে বা থানায় মানহানি মামলা করা হয়। আর তাতে আসামী করা হয় সম্পাদক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্টটি ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হওয়ায় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার করে বার্তা সম্পাদক ও চীফ রিপোর্টারকেও মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ তারা উক্ত ওয়েব সাইটের কোনো রিপোর্টার নন। উক্ত রিপোর্টটি ওয়েব সাইটে প্রকাশিত না হয়ে শুধুমাত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দেওয়া যেত না। বর্তমানে সকল রিপোর্টই পত্রিকার পাশাপাশি ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হচ্ছে। সুতরাং এই আইনটিকে সামনে রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। অন্যথায় যে কোনো সময় আমাদেরকে ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।

নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা

অসাবধানতাবশত রিপোর্টের কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা যায়। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতনের রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে এমনভাবে রিপোর্ট করা যাবে না যাতে উক্ত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায়। পরিচয় গোপন রেখে রিপোর্ট করলে কোনো অসুবিধে নেই। যদি নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ পায় তাহলে তাতে তার মানহানির ঘটনা ঘটে থাকে। এ জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৪ ধারায় এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। তাতে বলা হয়েছে-

‘১৪৷ (১) এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ (২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’

মামলার প্রতিবেদন করতে গিয়ে এই আইনে মামলার শিকার হয়েছে দৈনিক জনকন্ঠ। ২০০১ সালে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ওই সময়ের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় মামলা করেন এক নারী। ওই মামলার বাদীর ছবি প্রকাশ করে ২০০২ সালের ৪ ও ৫ জানুয়ারি জনকণ্ঠে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯ জানুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধনী) আইনের ১৪ (১) ও (২) ধারায় জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন ওই নারী।

অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০০২ সালের ১৯ জুন ওই মামলায় জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বোরহান উদ্দিন আহমদসহ (প্রয়াত) ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় বিচারিক আদালত।

এরপর ওই মামলা বাতিল চেয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ অন্যরা ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে হাই কোর্টে আবেদন করেন। এর আগের বছরই তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।

তাদের আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট রুল ও স্থগিতাদেশ দেয়। পরে ওই রুলে পক্ষভুক্ত হন মামলার বাদী ওই নারী। রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৮ এপ্রিল ২০১৬ সোমবার আদালত তা খারিজ করে রায় দেয়। ফলে এখন এ মামলাটির বিচার কাজ চলতে থাকবে।

সুতরাং আমাদেরকে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় যে কোনো সময় শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সম্পাদক-প্রকাশককে নিয়ে মামলায় জড়িয়ে যেতে হবে। অবশ্য রিপোর্টাররা মামলা ও জেল জুলুমের ভয় করে না। মামলা ও জেল - জুলুমের চেয়ে বড় বিষয় হলো, আমার রিপোর্টের কারণে যাতে কোনো নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি না হয়। কেননা মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হলো গণমাধ্যম। যখন আইন-আদালতসহ দেশের কোথাও কোনো প্রতিকার না পায় তখন মানুষ চেয়ে থাকে গণমাধ্যমের দিকে। ছুটে আসে সাংবাদিকের কাছে। মানুষের এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস যেন আমরা চিরকাল অক্ষুন্ন রাখতে পারি সে প্রত্যয়ই আমাদের থাকা উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও এডভোকেট

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর