thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

ভালুকায় ট্রাক উল্টে নিহত ১০

কম ভাড়ার মোহে লাশ হলো ওরা

২০১৭ মার্চ ২৪ ১৮:১৫:০৫
কম ভাড়ার মোহে লাশ হলো ওরা

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি : তিনদিনের ছুটি পাওয়া গেছে। তাই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসছিল স্বামী-স্ত্রী ও তাদের তিন শিশুপুত্র। হতদরিদ্র পরিবার তাদের। বেশি ভাড়ার গাড়িতে ভ্রমণ সম্ভব নয়। রাতে সুবিধামতো বাস না পেয়ে তাই সন্তানদের নিয়ে ট্রাকেই চড়ে বসেছিলেন ওই স্বামী-স্ত্রী। তাতে যে খরচটা অনেক কম পড়বে! কিন্তু বাড়ি ফেরা হলো না তাদের। পথিমধ্যে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মেহেরাবাড়ি নামকস্থানে রাস্তায় উল্টে পড়ে যায় তাদেরকে বহনকারী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকটি। এতে ঘটনাস্থলেই ওই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের তিন সন্তান প্রাণ হারায়। সঙ্গে মারা যান ট্রাকটির আরো ৬ যাত্রী।

শুক্রবার (২৪ মার্চ) আনুমানিক রাত ৩টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো বেশ ক’জন। গুরুতর আহত ৩ জনকে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

দুর্ঘটনায় একই পরিবারের নিহত ৫ সদস্য হলেন-ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার দাদড়া গ্রামের আজিজুল হক (৪০), তার স্ত্রী রেজিয়া খাতুন (৩৬) এবং তাদের তিন সন্তান মেহেদি (১১), মিজান (৮), সিজার (৪)। অন্যরা হলেন-ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরসিরতা গ্রামের মৃত কিতাব আলীর স্ত্রী জোস্না বেগম (৫৫) ও তার পুত্র সিরাজুল ইসলাম (১৮), শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকসি গ্রামের শাজাহান (৪০), নকলা উপজেলার ভাওয়ারকান্দা গ্রামের শুক্কুর আলী (৬৫) এবং শেরপুর জেলার জোহৌলদি গ্রামের মৃত আবু সামার পুত্র খোরশেদ আলম (২৫)।

ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তিকৃতরা হলেন-শেরপুর জেলার চান্দের পাড় এলাকার সিরাজুল ইসলাম, আব্দুস সালাম, নকলা খারগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস ও কান্দাপাড়া গ্রামের সলিম উদ্দিন।

নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এরা সকলেই হতদরিদ্র দিনমজুর ও রিক্সাচালক। গভীর রাতে বাস না পেয়ে কম ভাড়ায় ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ট্রাকে চড়ে ছুটি কাটাতে বাড়িতে ফিরছিলেন তারা।

এদিকে, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুররারজি দেশাই বর্মণ ও ভালুকা থানার ওসি মামুন অর রশিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান নিহতদের মরদেহ সুষ্ঠুভাবে বাড়ি পৌঁছানো ও দাফন সম্পন্ন করার বিষয়ে স্বজনদের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

এ দুর্ঘটনার তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ আহমেদকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চারলেন প্রকল্পের রাস্তা খোঁড়াখুড়ি এবং সংকেত না থাকায় ট্রাকটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। যে কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ভালুকার হাইওয়ে পুলিশ সার্জেন্ট জহিরুল ইসলাম জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকা উপজেলার মেহেরাবাড়ি নামকস্থানে শেরপুরগামী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকটি নির্মাণাধীন চারলেন মহাসড়কের ভাঙা গর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই সিমেন্টের বস্তার নীচে চাপা পড়ে মারা যায় নারী ও শিশুসহ ৯ জন। খবর পেয়ে হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সদস্য ও স্থানীয়রা ঘটনাস্থল থেকে ৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আরো একজন মারা যায়।

ভালুকা মডেল থানার ওসি মামুন অর রশীদ জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর মরদেহ উদ্ধার করে থানায় রাখা হয়। ট্রাকটিতে অতিরিক্ত মালের (সিমেন্ট বোঝাই এবং শক্ত সিমেন্টের বস্তা) কারণে চাপা পড়ে এতগুলো প্রাণ ঝড়েছে। বেলা ১টার দিকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্মাণাধীন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুর্ঘটনা কবলিত ওইস্থানে কোনো দিক নির্দেশনা ছিল না। ফলে গভীররাতে চালক কাটা সড়কটি বুঝতে না পারায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর ট্রাক চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানায়।

এদিকে, দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মডেল থানায় হতাহতদের স্বজনরা ভিড় জমায়। এ সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। স্বজনরা বিলাপের সুরে বলতে থাকেন, সামান্য কটা টাকা বাঁচাতে গিয়ে (তাদের স্বজনদের) প্রাণ দিতে হলো বস্তার নীচে চাপা পড়ে।

নতুন পাঞ্জাবি পড়া হলো না মেহেদির

‘আমার বোনের পরিবারের সব এক সাথে গেল। আমার ভাগিনা মেহেদিকে নতুন পাঞ্জাবী কিনে দিতে পারলাম না। আজ বাড়ি আসলেই তাকে নতুন পাঞ্জাবি কিনে দিতাম। ওর নতুন পাঞ্জাবির খুব সখ ছিল । সে মাদ্রাসায় অন্য সাথীদের সাথে নতুন কাপড় পড়ে ক্লাসে যেতে চেয়েছিল। বেশ কয়েকবার আবদারও করেছিল। তা আর হলো না। মনে হলেই যেন কান্নায় আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভাইগো, আজ সেই মেহেদি বাড়ি আসছে, কফিনে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে। ওরা সবাই একসাথে আমাদের ছেড়ে চলে গেল চির দিনের জন্য।’

ভালুকার মেহেরাবাড়িতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুতে শোকাহত রোকসানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন কথাগুলো। সম্পর্কে সে নিহত রাজিয়া খাতুনের বোন।

বোন রাজিয়া, তার স্বামী আজিজুল ও তাদের তিন সন্তানের লাশ নিতে এসে শুক্রবার দুপুরে ভালুকা মডেল থানায় বসে বিলাপ করছিলেন রোকসানা।

রোকসানা জানান, তার দুলাভাই আজিজুল হক ঢাকায় রিক্সা চালাতেন। থাকতেন বাসাবো এলাকার একটি বস্তিতে। বোন রাজিয়া বাসাবাড়িতে ঝিঁ এর কাজ করতেন। অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা বড় ছেলে মেহেদি নান্দাইল উপজেলার একটি মাদ্রাসায় অতিকষ্টে পড়াশোন করত। বাবা-মার’ সঙ্গে ঢাকায় থাকতো। তার মাদ্রাসায় ছুটি চলছে। তাই ছুটি কাটাতে বাড়ি আসছিল তারা।

এদিকে একই পরিবারের এই ৫ সদস্যের করুণ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তারাকান্দা উপজেলার দাদড়া গ্রামে। এলাকায় মরদেহ পৌঁছালে শতশত মানুষ ভিড় জমায় সেখানে। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় স্বজনদের মাঝে। তাদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠে।

বোনের বিয়ের টাকা জোগাড় করা হলো না সিরাজুলের

‘ভাইগো, বোনের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলো আমার ভাই সিরাজুল। বেঁচে নাই আমার মা’ও। আল্লাহ, কি সর্বনাশ হলো আমাদের। বোনের মেহেদি রাঙা রং আর দেখবে না ওরা। কয়টা টাকা রোজগারের জন্য ঢাকায় যাওয়া আমার মা-ভাইয়ের। ফিরে আসবে বোনের বিয়ের টাকা আয় করে। কিন্ত আজ সবই শেষ।’

ভালুকার ট্রাক দুর্ঘটনায় মা ও ভাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরসিরতা গ্রামের নজরুল ইসলাম। শুক্রবার দুপুরে ভালুকা মডেল থানায় লাশ নিতে এসে লাশঘরের পাশে বসে বিলাপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

নজরুল জানান, বোনের বিয়ের জন্য টাকা যোগাড় করতেই ৮/৯ মাস আগে ঢাকায় কাজে যায় তার ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম (১৮) ও তার মা জোস্না বেগম (৫৫)। তার মা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন আর ভাই রিক্সা চালিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতো।এর মধ্যেই কিছু টাকা সঞ্চয় করতো বোনের বিয়ের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোনের বিয়ে দিয়ে যাওয়া হলো না তার। জোস্না বেগমও দেখে যেতে পারলেন না মেয়ের বিয়ে।

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/মার্চ ২৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর