thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

প্রবাসীদের লেখা থেকে

রাখিবন্ধন

২০১৪ মার্চ ০৯ ২০:০৬:০৪
রাখিবন্ধন

সিকদার মনজিলুর রহমান

নির্মল চন্দ্র দে স্থানীয় কলেজের শিক্ষক। তিনি ইংরেজির ক্লাশ নেন, বাসায় টিউশনিও করেন। টুকু, মুরাদ, অনি ও বিজলী স্নাতক পরীক্ষার্থী। তারা নির্মল চন্দ্র দের ওখানে পড়ে। কোচিং শেষে রিকশার অপেক্ষায়। এমন সময় সেখানে একটা রিকশা আসে। রিকশাওয়ালা বলে, ‘যাবেন?’ অনি জবাব দেয়, 'যাব। কিন্তু আমরা চারজন, দুইটা রিকশা লাগবে।’

টুকু চঞ্চল প্রকৃতির। সে অনিকে বলল, আরে, দুই দিনপরে ডিগ্রি পাস করে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হবি। তোর মাথায় কিছু নেই! জানিস না? লেডিস ফাস্ট। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী…পুরুষ-শাসিত সমাজে লেডিসই সর্বেসর্বা। বিজলীই যাক। আমরা পরের রিকশায়, না হয় হেঁটে যাব।’

টুকুর কথা শুনে বিজলী মুচকি হাসে। মুরাদ বলে, 'ঠিক আছে বিজলী, তুমি যাও।’

বিজলীর রিকশা রাস্তার মোড় ছেড়ে দৃষ্টির আড়াল হতেই অনি মৃদু স্বরে গেয়ে উঠে—

‘সারাটা জীবন

করিয়া সাধন

পাইলাম না তার

মন।।
উজান গাঙ্গের নদীরে তুই

বলিস তারে গিয়া

উড়াল পাখি দিসরে খবর

আজো আছি চাইয়া

নিত্য সারাক্ষণ ...।’

হঠাৎ অনির কণ্ঠে এমন গান শুনে বন্ধুরা উৎসুক হয়ে ওঠে। মুরাদ জিজ্ঞেস করে, 'কিরে অনি, ঘটনা কী?

অনি সংকচ-জড়িত কণ্ঠে বলে— ইয়ে, আমি একজনকে ভালোবাসি। কিন্তু মেয়েটা আমাকে পাত্তাই দেয় না। বন্ধু সমস্বরে বলে, মেয়েটি কে?

অনি বলল, আর কে, বিজলী।

- বলিস কী? পাত্তাই দেয় না? টুকু জিজ্ঞেস করে।

- একদম না বললে ভুল হবে। দেখা হলে হেসে কথা বলে। পড়াশোনার কথা সহজভাবে আলোচনা করে। কিন্তু একটু অন্য কথা বললে কেমন চুপসে যায়, প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। মনের কথা বলার সুযোগই দেয় না। অনির কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে।

- বিজলীকে ভালোবাসিস, কিন্তু সে তোকে ভালোবাসে? মোক্ষম প্রশ্ন টুকুর।

- কী জানি, ঠিক বুঝতে পারি না।

- কোনো দিন আভাস ইঙ্গিতে ...?

- না, কোনো দিন তার মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখিনি।

- তা হলে সে হয়তো তোকে ভালোবাসে না।

টুকুর কথা অনির বুকে সূচের মতো ফোটে, চোখে-মুখে অন্ধকার নেমে আসে।

- তুই কিছু আঁচ করতে পারিস সে কেন তোকে পাত্তা দেয় না? বিজলী সুন্দরী, নাকি তোর গায়ের রং কালো বলে এমন অবজ্ঞা করে। বলে মুরাদ।

- না, না । কালো-ফর্সার কোনো ঘটনা না। ঘটনা অন্যখানে।

- কী? জিজ্ঞেস করল মুরাদ।

- মেয়েটি ভারী কনজারভেটিভ। সে যাই হোক আমি বিজলীকে ভালোবাসি। তাকে না পেলে বাঁচব না।

- এ সব কী বলছিল অনি? চল সামনেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। বলল টুকু। রেস্টুরেন্টে বসলে বেয়ারা পানি নিয়ে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী দেব?

- কে কী খাবি? টুকু জিজ্ঞেস করে।

- না, না । আমি কিছু খাব না। বলে অনি।

- আরে, না বললে হবে? ঠাণ্ডা, না গরম খাবি? বলে মুরাদ।

- কড়া চা সঙ্গে দু'টো করে সিঙ্গারা। টুকু বলে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টুকু বলে, অনি হতাশ হোসনে। মেয়েরা মনের কথা সহজে প্রকাশ করে না।

- তুই একটা কাজ কর, বিজলীকে ভুলে অন্য মেয়ের কথা ভাব। অনির মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো পরামর্শ দেয় মুরাদ।

টুকু ধমক দিয়ে বলে, আরে গাধা প্রেম কি কারওয়ানবাজারের কাঁচকলা নাকি যে এক দোকানেরটা পছন্দ হল না আরেক দোকান থেকে কিনবে?

ধমক খেয়ে চুপ করে যায় মুরাদ।

- তোরা তো আমার ব্যাপারে কোনো রকম মাথা ঘামাস না। অভিযোগ অনির।

- আমরা তোর জন্য চিন্তিত। কিন্তু কোনো পথ পাচ্ছি না। আত্মপক্ষ সমর্থন করে মুরাদ।

- কোনো পথ বের করতে না পারলে আমাকে হারাবি। এভাবে বেঁচে থাকার মানে কী? বলে অনি। অনির কথায় মুরাদ ও টুকু ফের বিমর্ষ হয়ে ওঠে। অনি যে ওদের অভিন্নহৃদয় বন্ধু।


চা শেষ করে মুরাদ বলে, 'একটা কাজ কর অনি, বিজলীকে একটা পত্র দে।

- ধুৎ, প্রেমপত্র লেখার বয়স আছে নাকি?

- তাহলে এক কাজ কর, বিজলীর কোনো বান্ধবীকে দিয়ে তোর মনের খবরটা তাকে জানিয়ে দে। মুরাদ বলে।

- সে চেষ্টাও করেছি। বিজলীর বান্ধবী দিপাকে বলেছিলাম। তাতে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন ভষ্ম করে দেবে। আর বিজ্ঞের মতো জ্ঞান দিয়ে বলেছিল, 'ফাজলামো না করে পড়াশোনায় মন দে।’

বন্ধুরা সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজতে থাকে। অবশেষে টুকু সমাধানসূত্র আবিষ্কার করে উল্লাস করে ওঠে। মুরাদ ও অনি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। অনিকে বলে, কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার দে। অনি বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করে।

বোতলের মুখ খুলতে খুলতে টুকু প্রশ্ন করে,পরশু কী বার?

- ১৪ ফেব্রুয়ারি, রবিবার। উত্তর দেয় মুরাদ।

- অর্থাৎ, 'ভ্যালেন্টাইন ডে’।

- তাতে কী হয়েছে? প্রশ্ন অনির।

- পরশুই তোর সমস্যার সমাধান হবে।

- কিন্তু কীভাবে?

- তুই ঐদিন একটা উপহার কিনে বিজলীকে দিবি। বিজলী যদি সেটা গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে তোকেও কোনো উপহার দেয়, তা হলেই কেল্লাফতে।

- সে যদি উপহার গ্রহণ না করে? যদি রেগে যায় ?

- চেষ্টা করতে দোষ কী?

- তা হলে আমাকে কী করতে হবে?

- বিশেষ কিছু না। বিজলীর জন্যে তোকে সুন্দর একটা উপহার কিনতে হবে।

- কী উপহার কিনব?

- তাও আমাকে বলে দিতে হবে? তবে দাঁড়া ! একটু চিন্তা করে টুকু বলে ‘বই ' বইয়ের চেয়ে সেরা উপহার আর কী হতে পারে? বাংলা একাডেমীতে একুশের মেলা চলছে। কোচিং ক্লাশ শেষে কাল চল মেলায় যাই। দেখে-শুনে সুন্দর একটা বই কিনি।

- আচ্ছা। অনির সম্মতি।

পরের দিন বিকেলে ওরা মেলায় যায়। ওই দিনের উপযোগী বই কেনে। বইটি কিনে ওরা শাহবাগের মোড়ে একটা ফুলের দোকানে এসে টাটকা একটা গোলাপ কেনে। সাথে একটা গিফট বক্স। টুকু বলে, এইগুলো বিজলীকে উপহার হিসেবে দিবি। ব্যস, তোর কাজ শেষ। অনির মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেলেও চিন্তিত কণ্ঠে বলে, আমি কি পারব?

টুকু বলে, পারবি। তোকে যে পারতেই হবে। পড়া বুঝে নেওয়ার অজুহাতে বিজলীদের বাসায় ফোন করে জেনে নিবি কাল সে কখন বাসায় থাকে? কখন কী করিস অবশ্য আমাদের জানাস। টুকুর পরামর্শ মতো বিজলীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। বিজলীর বাসার লোক যাতে সন্দেহ না করে সে জন্য হাতে করে একটা পড়ার বইও নিয়ে যায়। বিজলী তার পড়ার ঘরেই ছিল।

তার ঘরে ঢুকে বইয়ের একটা অংশ বুঝিয়ে দেয়। পড়াশোনার পালা শেষ হলে অনি ব্যাগ খুলে আগে গোলাপটা বিজলীর হাতে দেয়। তারপর বইয়ের প্যাকেটা তার হাতে দিয়ে বলে, বিশেষ দিনের সামান্য উপহার। মনে শংকা নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকে। কোনো বিস্ফোরণ ঘটল না, হাসিমুখেই উপহার গ্রহণ করে বিজলী।

বাঃ, ফুলটা বেশ সুন্দর তো !

হ্যাঁ , সুন্দর ! ঠিক তোমারই মতো । সাহস পেয়ে অনি বলে।

বিজলী প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলে, এতে কী?

- খুলে দেখ।

বিজলী প্যাকেট খুলে বইটির নাম পড়ে।

অনি ইতস্ততঃ হয়ে বলে, এবারের বই মেলায় বেরিয়েছে।

- বইটি কেমন?

- আমি তো এখনও পড়িনি। কাল মেলায় কেবল এসেছে।

- তুমি যখন পড়নি। তাহলে বইটি তুমিই নিয়ে যাও।

- কষ্ট পেলাম। বইটি তো তোমার জন্যেই এনেছিলাম। ফেরত দেবে?

- ঠিক আছে। তুমি যখন বলছ রেখেই দিচ্ছি, তবে তোমাকেও কিছু উপহার দেওয়ার আছে।

- আচ্ছা দাও। মনে মনে বলে, তোমার উপহার পাওয়ার জন্যে আমি যে উদ্গ্রীব হয়ে আছি।

- এখন নয় বিকেলে এস। এ-বেলা যেমন পড়ার অজুহাতে এসেছ, ও-বেলাও তেমনি চলে এস।

- ঠিক আছে, তাই হবে।

টুকু ও মুরাদ দেবুর রেস্টুরেন্টে অধীর আগ্রহে বসে আছে। অনি ফিরে আসতেই টুকু তাকে ঘিরে ধরে, 'ঘটনা কি?’

অনির ঠোঁটে হাসি। মুখে বলে , ভালো না। দু'টো করে মিষ্টি আর চায়ের অর্ডার দেয়। ওরা বোঝে, খবর ভালো। মিষ্টি খেতে খেতে অনি ঘটনার বর্ণনা দেয়।

দেখ আমার কথায় শেষ পর্যন্ত কাজ হল। গর্বের সাথে বলে টুকু।

- সত্যিই তোর বুদ্ধির তুলনা হয় না। কৃতজ্ঞতার স্বরে বলে অনি।

সারাদিন মহা-আনন্দে কাটাল অনির। তার সৌজন্যে টুকু ও মুরাদের সময়টাও ভালো কাটে। তবু সময় যেন আর কাটতে চায় না। পাঁচ মিনিট অন্তর ঘড়ির কাঁটা দেখে অনি। এভাবে কোনোপ্রকারে পাঁচটা বাজায়। 'তোর যাত্রা শুভ হোক’ বলে মুরাদ ও টুকু অনিকে বিদায় জানায়।

এরপর শুধু প্রতিক্ষা । অবশেষে ঘণ্টা খানেক পরে অনি ফেরে । তার হাতে একটা প্যাকেট।

- এতক্ষণ কী করছিলি? প্রশ্ন করে টুকু।

- প্রথমে একটু পড়াশোনার কথা, তারপর নানা গল্প। সত্যি এমন দিন আমার জীবনে আগে কখনও আসেনি। এই প্যাকেটে কী আছে?

- এটাই তো ওর দেওয়া ভ্যালেন্টাইনের উপহার।

টুকু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখে বেশ ভারী। শক্ত করে মোড়া। প্যাকেটটা অনির হাতে ফেরত দিয়ে বলে, 'তোর উপহার , তুই-ই খোল।

অনি ধীরে ধীরে প্যাকেটটা খুলতে থাকে। টুকু ও মুরাদ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। প্যাকেটটা পুরো খুলেই চেয়ারে উল্টে পড়ে সে। টুকু তাকে ধপ করে ধরে ফেলে, না হলে হয়তো মেঝেতেই পড়ে যেত। প্যাকেটের ভেতর রয়েছে দু'টো চকোলেট বার, একটা বই আর হলুদ রঙের একটা রাখি এবং একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা, “রাখি পূর্ণিমা উপলক্ষে স্নেহের ভাইটির জন্যে আগাম উপহার, শুভ রাখিবন্ধন।”

টুকু ও মুরাদ অনির চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে।

আটলান্টা, জর্জিয়া

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর