thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

জিডিপি বাড়লেও কমেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশীদারত্ব

২০২২ জুলাই ০১ ১৬:৪১:৩১
জিডিপি বাড়লেও কমেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশীদারত্ব

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: আমাদের জিডিপি বাড়ছে, তবে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশীদারিত্ব কমে যাচ্ছে। যারা জিডিপি বাড়াচ্ছেন, সেই শ্রমিকরাই এর বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

শুক্রবার (১ জুলাই) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দ্রব্যমূল্য, শ্রমিকের জীবন ও মজুরি প্রশ্ন শীর্ষক সভায় এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি।

আনু মুহাম্মদ বলেন, যেহেতু আমাদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই, সেহেতু এটা কমেই যাচ্ছে। এর ফলে সব থেকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। শ্রমিকদেরও কোনো সংগঠন করতে দেওয়া হয় না। ফলে সাধারণ শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলেই তখন শিল্প পুলিশ দিয়ে ধরপাকড় করা হয়। কিন্তু এই শিল্প পুলিশদের কখনও মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বলা যায়, মাস্তান বাহিনীর মতোই শিল্প পুলিশ কাজ করে মালিকদের পক্ষে।

শ্রমিকরা যে মজুরি পায় দ্রব্যমূল্য না বাড়লেও তাদের এ মজুরি যথার্থ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, এর প্রভাব হিসেবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা। আমাদের শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে শিল্প ডাক্তার তৈরি করতে হবে।

সভায় এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন গণ সংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ তৌফিক জোয়ারদার, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাহিন সুলতানা, অ্যাক্টিভিস্ট ফরিদা আক্তার, টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহমুদুর রহমান ইসমাইল প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার।

বক্তারা বলেন, বাজেটে শ্রমিকদের জন্য কোনো খাত হয়নি। বর্তমান বাজারে ৮ হাজার টাকা পাওয়া পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষেরা এমনিতেই অর্থাভাবের কারণে শর্করা জাতীয় খাদ্য চাল, আলুর উপর নির্ভরশীল। এখন যাবতীয় নিত্য-পণ্যেও দাম বাড়ার কারণে শর্করা জাতীয় খাবারসহ সবরকম খাবারেই চাপ বেড়েছে।

আগে যদি একটি পরিবার ৫ কেজি তেল ব্যবহার করতো, এখন তারা ২ কেজি তেল ব্যবহার করে। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ সরাসরি তাদের খাদ্য চাহিদায় ও পুষ্টিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। শ্রমিকরা চা, রুটি, কলা যেসব নাস্তা হিসাবে খান সেসবেরও দাম বাড়ায় এখন সেটুকুও খেতে পারছেন না। ফলে এই দাম বৃদ্ধি শুধু মুখে বিরোধিতার বিষয় না, তাদের একেবারে গায়ে লাগার মতো ঘটনা।

যে শ্রমজীবী একরকম নিজের শরীর খেয়ে এবং দিন রাত পরিশ্রম, ওভার টাইম করে সামান্য পারিশ্রমিকে চলে তার পক্ষে এই অবস্থায় ধৈর্য্য-শৃঙ্খলার পরীক্ষা দেওয়া বিলাসিতা মাত্র। এ কারণেই গত ৪ থেকে ৭ জুন পর্যন্ত হঠাৎ ক্ষেপে উঠতে দেখেছি মিরপুরের পোশাক শ্রমিকদের। তাদের মুখে একটা কথাই ছিল- দ্রব্যমূল্য কমাও মজুরি বাড়াও। শ্রমিকদের এ বিক্ষোভে ফেটে পড়ার ঘটনা আমাদের বিচলিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। এর মাঝে নিদারুণ পেটের ক্ষুধা আর পরিবার পরিজন নিয়ে অথৈ সমুদ্রে অনিশ্চয়তায় পড়ার ভয় ও ক্ষোভ ছাড়া আর কোনো ‘চক্রান্ত’ খুঁজে পাইনি আমরা। আমরা মনে করি, নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের কারণেই আজ শ্রমজীবীসহ দেশবাসী দিশেহারা।

তারা আরও বলেন, পোশাক খাতে শ্রমিকরা ৮ হাজার টাকা বেতনে প্রায় চার বছর পার করছেন। এই ৪ বছরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে ২০১৮ সালে ৮ হাজার টাকা বেতন বাড়লেও তার জীবন মান বৃদ্ধি পায়নি। প্রত্যেকটা ধাক্কা শ্রমিকের জীবনকে যেন এক অতল গহ্বরে টেনে নামাচ্ছে। অথচ আমরা দেখি উদ্যোক্তারা ঠিকই প্রত্যেকটা ধাক্কা সামলে বার বার ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন।

বর্তমানে সরকারও অনিয়ন্ত্রিত বাজারের এই দায় বিশেষভাবে দেয় আন্তর্জাতিক ভুরাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণসহ আমদানীদ্রব্যে কর কমানোর যথাযথ উদ্যোগ অনুপস্থিত। এই পুরো পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি বর্তমান দেশিয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শ্রমিকের চাহিদা কমানোর বদলে মালিকের চাহিদা কমানো এবং শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

এছাড়া এসব শ্রমিকের মধ্যে যারা ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, ৩৫ বছর বয়স পার হলেই তারা বেশি অসুস্থ হয়। এরপর তারা ফার্মেসি থেকে চিকিৎসা নেয়। অতিরিক্ত কাজের ফলে তাদের চোখ শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডাক্তাররা প্রকৃতপক্ষে থাকেন সকাল ১০টা থেকে সর্বোচ্চ দুপুর ১টা পর্যন্ত। এই সময়ে একজন শ্রমিকের পক্ষে তার একদিনের কাজ বন্ধ করে ডাক্তার দেখানো সম্ভব না। ফলে তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগেন। আমাদের ইন্ড্রাস্টিয়াল পুলিশ আছে, কিন্তু ইন্ড্রাস্টিয়াল ডাক্তার নেই। সেদিক থেকেও আমাদের আরও শ্রমিক উপযোগী হওয়া প্রয়োজন।

সভায় বিভিন্ন শ্রমিক বলেন, শ্রমিকদের বেতন ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোনো রকমে একটা ঘর নিয়ে থাকলেও তাতে খরচ হয় চার হাজার টাকা। বাকি চার হাজার টাকায় তাদের সারা মাসের বাজার করতে হয়। ফলে আমাদের খাবারের মান কমেছে।

অধিকাংশ শ্রমিক বড় মাছ খেতে পারে না। মাছের মধ্যে তাদের প্রধান খাবার পাঙ্গাস। অথচ তারা যে পাঙ্গাস মাছ বা কমদামী চাষের মাছ খায়, সেগুলোও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এগুলো চাষ করা হয় পুকুরে, ব্রয়লারের উচ্ছিষ্ট বর্জ্য দিয়ে। তারা যে মোটা চাল খায়, সেটির দামও বেড়েছে। দীর্ঘদিন মোটা চাল খেলে শুরু হয় ডায়াবেটিসের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা। গত এক বছরে খুব কম সংখ্যক শ্রমিকই গরুর মাংস খেয়েছেন। তাদের কোনো সঞ্চয় নেই। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করার জন্য টিসিবির ট্রাক থেকেও পণ্য কেনার সুযোগ নেই।

মজুরির বিষয় তো আছে, কাজের সময় অনেক শ্রমিককে বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত মালিক পক্ষ থেকে দেওয়া হয় না। অনেক শ্রমিক তাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতে পারছে না এবং অভাবের তাগিদে তারা ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই তাদের আবার শ্রমিক হিসেবে যোগদান করানো হচ্ছে।

এ সময় সভা থেকে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এগুলো হলো- অবিলম্বে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতায় আনা; মিরপুর-উত্তরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মজুরি আন্দোলনকারীদের হামলা, মামলা-গ্রেফতার বন্ধ করা; অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করে নতুন মজুরি নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া; শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজারের কম না করা এবং পোশাক শ্রমিকের জীবন-জীবিকার মান নিশ্চিতের দায় মালিক, সরকার ও বায়ার সব পক্ষকেই নেওয়া; নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত মহার্ঘ্য ভাতা এবং শ্রমিকদের রেশনিং ও সামাজিক সুরক্ষার অধিকারের আওতায় আনা এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

(দ্য রিপোর্ট/মাহা/ ০১ জুলাই, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

অর্থ ও বাণিজ্য এর সর্বশেষ খবর

অর্থ ও বাণিজ্য - এর সব খবর