thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

 

বর্ষবরণ : বাঙালী জাতীয়তাবোধের শেকড় সন্ধান বীরেন মুখার্জী

২০১৪ এপ্রিল ১৪ ১৩:৪৯:১৪
বর্ষবরণ : বাঙালী জাতীয়তাবোধের শেকড় সন্ধান
বীরেন মুখার্জী

কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। নদীমাতৃক এ দেশে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত এবং ঋতুভিত্তিক। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধার্য হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। বলা যায়, বাংলা সন গণনার সময়পর্ব থেকে বাঙালী জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির এই শুভ সূচনা। তবে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বাঙালীরা বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নভাবে দিনটি পালন করত বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। পহেলা বৈশাখ দিনটি যতটা ধর্মীয় অনুভূতিসিক্ত, তারচে’ বেশী গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় বাঙালীর সর্বজনীন সংস্কৃতির দিন হিসেবে।

সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুরাজীর আবর্তন-বিবর্তনের ধরন সংক্রান্ত জ্ঞান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এরপর এসেছে জ্যোতিষশাস্ত্র। মানুষ দিন, মাস, বছর গণনায় পারদর্শী হয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা-উড়িষ্যায় ইলাহী সন, ফসলী বা মৌসুমী সন ও বিলায়েতী সনের প্রচলন ছিল। ঘরে ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে খাজনা আদায়ের সময়টি সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় বাঙালী জনগণকে ব্যাপক সমস্যার সস্মুখীন হতে হতো। এ জন্য সম্রাট আকবর জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিদ আমীর ফতেউল্লাহ্ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ উদ্ভাবন ও প্রচলন করেন। পরে বঙ্গাব্দ হিসেবে এটি পরিচিত ও গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই বাঙালী কৃষি সমাজে দিনটি সমাদৃত ও পূজিত হয়ে আসছে।

লৌকিকতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’; অর্থাৎ জীবনের সব জীর্ণতা-দীর্ণতা বিদায়ের দিন হিসেবে গণ্য এই পহেলা বৈশাখ। বৈশাখের সঙ্গে বাঙালীর বিশ্বাস এবং অভ্যাস জড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে নানাবিধ সংস্কার। পহেলা বৈশাখ যেমন বাঙালীর হৃদয়ে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে, তেমনি ‘ভূমিহীন’ অর্থাৎ বর্গাচাষীদের জন্যও যন্ত্রণাদায়ক দিন হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রচলনের শুরুতে বছরের এই প্রথম দিনে সম্পাদন করা হতো জমিদারের রাজস্বের হিসাব। প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে মিষ্টি খেয়ে যেত। ব্যবসায়ীরা লাভক্ষতির হিসাবের পুরনো খাতার পালা চুকিয়ে নতুন খাতার সূচনা করতেন। যার নাম— হালখাতা। ‘হাল’ মানে তো নতুন বা চলতি, তাই নতুন হিসেব সংরক্ষণের অনুষ্ঠানরূপেও গণ্য হতো বছরের প্রথমদিনটি। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে সিঁদূরচর্চিত আম্রপল্লব শোভিত মঙ্গলঘট স্থাপন করে আত্মীয়-বন্ধু, খাতক, মহাজনদেরকে মিষ্টিমুখ করানো হতো। এভাবে লৌকিক সামাজিকতার নবায়ন হতো। এ অবশ্য বাঙালীর অতীত ইতিহাস। সে সময় ‘আমানী উৎসব’ অর্থাৎ পান্তাভাত খেয়ে মাঠে যাবার প্রথাটি পহেলা বৈশাখের অঙ্গীভূত বলে বিবেচনা করত ভূমিজীবী মানুষ। গ্রামের বধূরা বর্ণবৈচিত্র্যময় নতুন শাড়িটি অঙ্গে জড়িয়ে উৎফুল্ল হতো। বর্তমান সময়ে সমাজে যে বহুবর্ণিল নববর্ষ উৎসব উদযাপন— তা অতীতে গ্রাম্য বধূদের সাজ পোশাকের বিশেষত্ব নিয়েই জাগ্রত। তা ছাড়া বিগত দিনে লোকসংস্কৃতি-আশ্রয়ী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি পরিবেশন করা হতো সেগুলো এখন ‘আধুনিক ফর্মে’ পরিবেশিত হচ্ছে। বলা যেতে পারে, বাঙালীর প্রকৃত জীবনেতিহাস অতীতের সঙ্গেই নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। যে কারণে বাঙালীর আত্মানুসন্ধানের জন্য ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উৎসবের স্মরণাপন্ন হতে হয়।

বৈশাখের যে লৌকিকতা তা শুরু হয় পরিবার থেকে। আত্মীয়, বন্ধু, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশী সুহৃদজনকে শুভেচ্ছা জানানো ও কুশল বিনিময় চলে ছোট-বড়দের মধ্যে। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় বহু মানুষের সমাগম হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ মহামিলনের ক্ষেত্র এই মেলা। বছর শুরুর আগের দিন বসে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, পরবর্তীকালে নববর্ষ-উৎসবের সঙ্গে এ মেলা একীভূত হয়। শিশু-কিশোররা চরকি, নাগরদোলা, বাঁশি, তালপাতার রকমারী আয়োজন নিয়ে আনন্দে মেতে উঠত। কিশোরীরা ব্যস্ত হতো চুড়ি, ফিতে, চুলের ক্লিপ, আলতা, কাজল ইত্যাদি কেনার জন্য। তাদেরকে মেলায় নিয়ে আসা অভিভাবকদের ওপর বাড়ির গৃহিণীদের ফরমাইশ থাকত— দা, বঁটি, চালুনী, কুলো, টুকরি ইত্যাদি গৃহস্থালি-কর্মের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার। বাড়িঘরে ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা, শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যদিয়ে পূর্ণ আনন্দের সঙ্গে দিনটি অতিবাহিত করার মধ্যে নিহিত থাকত বছরের সব দিনের শুভ প্রত্যয় ও বিশ্বাস। মূলত এ সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালী ঐতিহ্যের উন্মেষ ঘটে অতীত থেকে। বিবর্তিত জীবনধারায় লৌকিক এ ধারাটি এখনো প্রবহমান। আর এ সব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই বাঙালীর আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র নিহিত।

পৌরাণিক বৈশাখ : হিন্দু পুরাণে বৈশাখ নিয়ে নানা তথ্য বিবৃত রয়েছে। যা বৈশাখের অতীত স্বরূপ বোঝাতে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। লোকগবেষক আতোয়ার রহমান ‘বৈশাখ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বৈশাখ তার নামের জন্য বৈশাখ নক্ষত্রের কাছে ঋণী। পুরাণের মতে বিশাখা চন্দ্রের সপ্তবিংশ পত্নীর অন্যতম। এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে কেবল নক্ষত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের অবস্থানের সাথে বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থানের সম্পর্ক দেখে মাস ভাগ এবং মাসগুলির নামকরণ করেছিলেন। বিশাখা উষ্ণতার সূচক।’ সঙ্গত কারণে বৈশাখের সঙ্গে যে ‘উষ্ণতা’ বা ‘খরতাপ’-এর সামঞ্জস্য রয়েছে তা বলা বাহুল্য। বৈশাখের স্বরূপ বিশ্লেষণে এই দিকটির গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। কবি কালিদাস তার ‘ঋতু সংহার’-এ বৈশাখ তথা গ্রীষ্ম ঋতুর সূচনা নিয়ে অবিস্মরণীয় কবিতা রচনা করেছেন।

আমাদের দেশের মতো বিশ্বের নানা দেশে বর্ষবরণের প্রচলন রয়েছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মিশ্রসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলেও বাঙালীর নিজস্বতা একেবারে বিলীন হয়নি। দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে মাত্র। সুতরাং বৈশাখ বা নববর্ষ পালনের যে বর্তমান চাকচিক্য তাতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাশ্চাত্যের বর্ষবরণের আদলে আমাদের দেশেও বর্তমানে কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, সংগীত-নৃত্যের মাধ্যমে প্রাণে গতিসঞ্চার এবং সর্বশেষ ফোন সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ ও ফেসবুকীয় শুভেচ্ছা বিনিময় এ ক্ষেত্রে নবতর ধারার সূচনা করেছে। তবে, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে বাঙালীর আদী সংস্কৃতি যেমন, যাত্রা ও পালা, কবি গান, গাজীর গান, আলকাপ, পুতুল নাচ, বাউল-মুর্শিদী-ভাটিয়ালী গান, লাইলী-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা ইত্যাদি পালা প্রদর্শনের আয়োজন করা হয় প্রত্যন্ত গ্রামে। এ ছাড়া ষাঁড়দৌড়, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ যুদ্ধ এবং কোথাও কোথাও নৌকাবাইচেরও আয়োজন করা হয়।

বৈশাখের পৌরাণিক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ দেখা যায়, ‘মাস হিসেবে বৈশাখের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, যা প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়। খররৌদ্র, দাবদাহ, ধু ধু মাঠ, জলাভাব, কালবৈশাখীর ঝড়, ঝরাপাতা, গাছে গাছে নতুন পাতার আবির্ভাব, আমের কলি ইত্যাদি প্রকৃতি-পরিবেশের রূপ-রূপান্তরের সঙ্গে বাংলার মানুষের মন-প্রাণ-আত্মার যোগ আছে।’১ ফলে তৎকালীন সমাজে বৈশাখের প্রথম দিনটির জন্য কৃষিজীবীদের অন্যরকম অপেক্ষা কাজ করত। এই দিনটি আসার আগেই ঘর-বাড়ি পরিচ্ছন্ন করা, ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবসা ক্ষেত্র ধোয়া মোছা করা হতো। এ কাজগুলোর মধ্যে সামাজিক সফলতার কাঙ্ক্ষা নিহিত থাকত। গোটা বছরটি ভালোভাবে অতিবাহিত হওয়ার বিশ্বাস থেকে প্রতিটি পরিবার এ দিনটিকে যথাসাধ্য আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করত। সৌভাগ্যের সূচক বড়সড়ো মাছ, মিষ্টির হাড়ি আসত ঘরে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে তৈলবিহীন নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্না করার রীতিরও প্রচলন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের; পরদিন সমারোহে মাছ খাওয়ার সঙ্গতি বাঁচিয়ে রাখার কথা বিবেচনা করেই।

জাতীয়তাবোধের বৈশাখ : বাঙালী জাতি বার বার বিদেশী শক্তির শাসন-শোষণে, নিপীড়িত-নিঃগৃহিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-উৎসব পালনে বাঙালী জাতিকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে— যা আজ ইতিহাস। এরপরও বাঙালী তার আপন সত্তা ও ঐতিহ্যিক আদর্শ বিচ্যুত, অথর্ব জাতিতে পরিণত হয় নি। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগোত্তর সময়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানভূমির অসাড়তা প্রমাণিত হওয়ার পর প্রগতিশীল ছাত্র-বুদ্ধিজীবীর চেতনায় পহেলা বৈশাখ নতুন রাজনৈতিক মাত্রায় বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার প্রশ্নে শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালীর বিক্ষোভ এ জাতির মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে তা প্রকারান্তরে বাঙালী জাতিসত্তার উন্মেষ। তখন থেকে বাংলা নববর্ষ ভিন্নমাত্রা নিয়ে বাঙালী জাতি উদযাপন করতে শুরু করে। তখন যে অনুষ্ঠানই করা হোক না কেন তা ছিল পাকিস্তানী শাসনাধীনে বাঙালী সংস্কৃতিকে ধ্বংসের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ। এর মধ্যে নববর্ষ বা বাংলা বর্ষবরণ উৎসব হয়ে উঠেছিল বাঙালী চেতনার ধারক ও বাহক। এ সব উৎসব প্রগতিশীল চেতনায় বিস্তার লাভ করে প্রতিটি প্রতিবাদে, আন্দোলনে, সংগ্রামে অলক্ষ্যে প্রেরণা যুগিয়েছে। তবে, বাঙালী জাতিগোষ্ঠী বর্তমান সময়ে এসে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে যে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে তা উপনিবেশিক আমলে অতটা সহজ ছিল না। বাংলা সংস্কৃতির ওপর বার বার যে আঘাত এসেছে সে সম্পর্কে গবেষক ওয়াকিল আহমদ বলেন, ‘আজকের প্রজন্ম নববর্ষকে যেভাবে পালন করে, স্বাধীনতার পূর্বকালে সেভাবে পালন করার সুযোগ ছিল না। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, বরং রাখ-ঢাক করে কিছু লোক ছোট-খাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। তারা তা করতেন জাতীয়তাবোধের প্রণোদনা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাব আছে; এই ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ষাটের দশকে এরূপ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমরা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হই— পাকিস্তানী সংস্কৃতির বরখেলাপ করে বাঙালী সংস্কৃতির আমদানী করছি। তারা ঠিকই ধরেছিল। সে-দিন জাতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার পুলক আমাদের অন্তরে কাজ করেছিল— কথাটা সত্য। রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীত চর্চা বন্ধ করার যে চক্রান্ত হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল একই— বাঙালী জাতীয়তাবোধকে ধ্বংস করা। ১৪ ডিসেম্বর ‘৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে এটা অন্যতম বড় কারণ ছিল। আমরা সে-দিন অমর একুশের মতো বাংলা নববর্ষকে আনুষ্ঠানিক পালন করে আমাদের স্বাধীকার চেতনা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত রাখতে চেয়েছিলাম।’২ পাকিস্তানী শাসনামলে পূর্ব বাংলাকে মুসলমানদের ভূখণ্ড বিবেচনা করত পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী। তারা পহেলা বৈশাখকে প্রকৃতি-পূজা বা হিন্দুদের আচার হিসেবে প্রচার চালিয়ে কৌশলে বাঙালী জাতিকে ঐতিহ্যহীন করার যে ষড়যন্ত্র করে তাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। এরপরও বাঙালী তরুণরা জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠী ও শাসকের রক্তচক্ষুর আড়ালে আয়োজন করতেন বৈশাখী অনুষ্ঠানমালার। যেখানে বাধা, সেখানেই তা অতিক্রমের প্রয়াস জোরালো হয়ে ওঠে। এভাবেই পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠতে থাকে বাঙালীর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও হাতিয়ার। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা সংস্কৃতি সচেতন হতে শুরু করে এবং ’৭১-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে অস্তিত্বের পুনরুদ্ধার করে।

সংস্কৃতির রূপ : নদীমাতৃক গ্রাম থেকে উদ্ভূত এই উৎসব আজ শহরে, নগরে, রাজধানীতে সম্প্রসারিত হয়েছে। নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশাল এক অসাম্প্রদায়িক আনন্দ মেলার রূপ পরিগ্রহ করেছে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর বৈশাখী মেলা। এটি এখন আর ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-ক্ষতির হিসেব-আশ্রয়ী হালখাতানির্ভর অনুষ্ঠানমাত্র নয়, এ অনেক ব্যাপক, দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ আমাদের অন্যতম জাতীয় উৎসব। বাঙালী জাতীয়তার এবং আত্মপরিচয়েরও ভিত্তি। এই দিনটি এলে, সবার অন্তরঙ্গ একাত্মতার মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় যেন গৌণ হয়ে যায়, বড় হয়ে ওঠে বাঙালীত্বের অনুভব। প্রতিবছরই এতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসমাগম এবং উৎসাহের জোয়ার। দেশের সর্বত্র, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুভূত হয় এর স্পন্দন। অবশ্য, নববর্ষ উৎসব পালনের ধরন নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেউ কেউ এর মধ্যে বিজাতীয় ঐতিহ্যের গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু যেভাবেই পালিত হোক, বাঙালী একটি দিনের জন্য হলেও তার জাতিসত্তাকে অনুভব করে, শেকড়ের কাছে ফিরে আসে।

পরিশেষে বলা যায়, পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে আবাহন করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই পালিত হয়ে আসছে বর্ষবরণ-উৎসব। নতুন সম্ভাবনার প্রত্যাশায় নতুনকে বরণ করার এই রীতি বাঙালী জাতীয়তাবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পহেলা বৈশাখ নানানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ— কোথাও এর উপলক্ষ ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোথাও আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে। পহেলা বৈশাখের উৎসব আয়োজনের মধ্যে বাঙালীর হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়। সঙ্গত কারণে বাঙালী জাতিসত্তা-অনুভূতি নবায়নের দিনও এটি। বাঙালীর আত্মানুসন্ধানে বারবার ফিরে যেতে হয় লৌকিক বিশ্বাস আশ্রিত গ্রাম্য সংস্কৃতি ও লৌকিক উৎসবের গভীরে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

সহায়তা :
১. বাংলা নববর্ষের চেতনা, প্রবন্ধ : ওয়াকিল আহমদ১
২. বাংলা নববর্ষের চেতনা, প্রবন্ধ : ওয়াকিল আহমদ২
৩. লোকজীবন ও বৈশাখী মেলা, প্রবন্ধ : মোহাম্মদ সাইদুর।
৪. বৈশাখ, প্রবন্ধ : আতোয়ার রহমান।
৫, বাংলাদেশের উৎসব নববর্ষ, সম্পাদক : মোবারক হোসেন।
৬. লোকউৎসবে ঐহিত্যচেতনা, সম্পাদনা : শাহিদা খাতুন।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর