thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

জোরদার হচ্ছে নববর্ষে উৎসব ভাতা ও ছুটি বৃদ্ধির দাবি

২০১৪ এপ্রিল ১৬ ১৭:২০:২২
জোরদার হচ্ছে নববর্ষে উৎসব ভাতা ও ছুটি বৃদ্ধির দাবি

মুসলমানদের 'ফসলি কর' (ওশোর) ও অমুসলিমদের 'ভূমি কর' (খারাজ) আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তথা সকল ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষের বৃহত্তম উৎসবে পরিণত হয়েছে বাংলা সনের প্রথম দিন। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-মোক্তার, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পহেলা বৈশাখে খুব ভোরবেলাতেই নেমে পড়েন রাস্তায়। একসঙ্গে মেতে ওঠেন উৎসব-আনন্দে। কিন্তু এক দিনের সরকারি ছুটিতে তাদের মন ভরে না। সকাল থেকে নানা আড্ডায় ব্যস্ত থেকে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ফেরেন ঘরে। পরদিন অফিসে যাওয়ার তাড়ায় আবারও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে নববর্ষের উৎসবের আনন্দটা পুরোপরি ভোগ করা হয় না উৎসবপ্রিয় এই মানুষগুলোর। এ জন্য নববর্ষ উদযাপনে আরও দু-এক দিন সরকারি ছুটি বৃদ্ধির দাবি জানান তারা। পাশাপাশি বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা দেওয়ার দাবিও জানান তারা।

তাদের যুক্তি, বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর কমপক্ষে দুটি উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। প্রত্যেক বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে বেশ খুশি হন। কিন্তু বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দলমত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার প্রতিটি নাগরিক অভিন্ন উৎসবে মেতে ওঠেন বাংলা নববর্ষে, যার আবেদন ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে কম নয়। এ অবস্থায় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে একটি উৎসব ভাতা এখন সময়ের দাবি।

এ ছাড়া বর্তমানে ইরানের নওরোজ উৎসবের পর বাংলা নববর্ষ উৎসব বিশ্বে একটি মহীরুহ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক অর্থনীতি। ফ্যাশন উদ্যোগের প্রায় ২৫ শতাংশ বিক্রি হয় বাংলা নববর্ষে। এ ছাড়া বৈশাখী মেলায় রয়েছে নাগরদোলায় ঘূর্ণিপাক, তালপাতার ভেপুর আওয়াজ, খেলা, মিঠাই, হাঁড়ি-পাতিলের বেসাতি, লোকশিল্প সামগ্রীর বেচাকেনা, বাউল গান ও লোকগীতির অনুষ্ঠান। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইলিশ মাছ, ফুল-ফল, পোশাক-আশাক, গ্রামীণ খেলনা ও খাবার-দাবারের ব্যবসা, যার বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সেক্রেটারি ওসমান গনী জানান, ঈদের পরেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন সর্ববৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে সরকারি ছুটি বাড়ানোর পাশাপাশি উৎসব ভাতা দেওয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আব্দুল জলিল বলেন, বাংলা নববর্ষে দুই দিন ছুটি দেওয়া প্রয়োজন। এতে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারীরা উৎসবটা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন। কারণ এক দিনের ছুটিতে সারাদিন সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। পাশাপাশি নববর্ষে একটি উৎসব ভাতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তিনি।

এ বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা তা নিয়ে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে জাতীয় পে-কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ফরাসউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা দেওয়ার বিষয়টি কেউ তোলেনি। বিষয়টি যখন তুলেছেন, তখন আগামী পে-স্কেল ঘোষণার সময় ভেবে দেখা হবে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

একই বিষয়ে বেসরকারি খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি এবং পে-কমিশনের সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদের কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত ২৪ বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছি। বৈশাখে উৎসব ভাতা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসেনি। বিষয়টি কেউ বলেওনি। আপনি বিষয়টি যখন তুলেছেন, তখন এটি নিয়ে ভাবা দরকার। কারণ বাংলা নববর্ষকে ঘিরে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ছে। উৎসব ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের অর্থনীতির চাকা আরও সমৃদ্ধ হবে। আগামীতে পে-কমিশনের সভায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হবে।’

বাংলাদেশ এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের সভাপতি ফজলুল হক জানান, বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা বা বোনাস দেওয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ উৎসব ভাতা দেওয়ার মতো সবার সক্ষমতা আছে কিনা, তাও খেয়াল রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সনের সূচনা হলেও তা গণনার কার্যকারিতা শুরু হয় ৯৯২ হিজরি বা ১৫৫৬ সাল থেকে । এ ছাড়া আরবি 'সন' ফারসি 'সাল' শব্দের অর্থ বছর। এ জন্য 'বাংলা সন'কে বলা হয় বঙ্গাব্দ। বাংলা নববর্ষ পালনের সঙ্গে ইরান ও আরবের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদযাপন 'নওরোজ' অনুষ্ঠানের মিল পাওয়া যায়।

মুসলিম ফসলি সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের আগে অগ্রহায়ণ থেকে বছর গণনা করা হত। 'অগ্র' অর্থ শুরু 'হায়ণ' অর্থ বছর। অন্য মতে 'অগ্র' অর্থ শ্রেষ্ঠ 'হায়ণ' অর্থ ধান। কেননা, এ সময় প্রধান ফসল আমন বা শ্রেষ্ঠ 'হৈমন্তিক' ধান কৃষকের ঘরে উঠত। তবে বর্ষা শেষে সম্রাটের খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে তা শুষ্ক মৌসুমে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে চন্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনা রীতিতে পার্থক্যের কারণে কিছু বাস্তব সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- হিজরি সন ৩৫৪ দিনে এবং খ্রিষ্টাব্দ হয় ৩৬৫ দিনে। আবার বঙ্গাব্দ ও প্রচলিত ভারতীয় গণনা রীতিতে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। বঙ্গাব্দের সূচনা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক রাখার জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বছরের শুরুর ৫ মাস ৩১ দিন ও শেষ মাসগুলো ৩০ দিন নির্ধারণ করেন এবং আশির দশকে বাংলা একাডেমি ৮ ফাল্গুন (২১ ফেব্রুয়ারি) ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) ঠিক রাখার জন্য খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে মিলিয়ে অধিবর্ষ নির্ধারণ করে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন প্রচলন করে। আর ১৯৫৪ সালে 'যুক্তফ্রন্ট সরকার' প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালির জনপ্রিয় নেতা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। বাংলা নববর্ষ ও নওরোজ একই ধরনের উৎসব হলেও এ দিবস পালনে বেশ পার্থক্য রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইরানিরা নওরোজের দিন বাবা-মাসহ নিকটাআত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বেশ কয়েক দিন ছুটি থাকে। ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন। কেউ কেউ বিদেশেও যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন। যেমন- অনেকেই পবিত্র মাশহাদ শহরে বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হজরত ইমাম রেজার (আ.) মাজার জিয়ারত করেন। অনেকে এ উপলক্ষে পবিত্র কোম শহরে হজরত ইমাম রেজার (আ.) বোন হজরত মাসুমার (সা.) মাজারে যান, কেউবা ইরাকে হজরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মাজারে বা আহলে বাইতের অন্য কোনো সদস্যের মাজারে নববর্ষ শুরু করেন। ইমামদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মাজারেও এ সময় ভিড় দেখা যায়।

এ ছাড়া নওরোজের আগেই ইরানিরা ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা পাড়া-পড়শি ও আপনজনদের সহায়তা করেন। ঈদ বা নওরোজের আগেই অনেকে পুরনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে নতুন জিনিস কেনেন। নতুন জামা-কাপড়, জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তারা ব্যাপক পরিমাণ ফল, মিষ্টি ও অন্য খাদ্যসামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।

আর নওরোজের দিন অনেকেই একে অপরকে উপহার বা বখশিশ দিয়ে থাকেন। ছোট শিশুরা বড়দের কাছ থেকে বখশিশ পেয়ে খুব খুশি হয়। নওরোজ ইরানি, কুর্দি, তাজিক ও আজেরি জাতিসহ আরও কয়েকটি জাতির বৃহত্তম জাতীয় উৎসব। এ সব কারণে জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নওরোজ উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এ উৎসব আজ শুধু ইরানের জাতীয় উৎসব নয়, আফগানিস্তান, তাজিখস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকেও এ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয়। এ উৎসব কম-বেশি পালিত হচ্ছে জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। সাধারণত ২০ বা ২১ মার্চ ফার্সি নববর্ষ শুরু হয়। বসন্ত ঋতু শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় এ নববর্ষ। এ বছর চতুর্থ আন্তর্জাতিক নওরোজ উৎসব হয় আফগানিস্তানে। এতে অংশ নিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি আফগানিস্তান সফর করেন। আফগান সরকার ওই নওরোজ উৎসবের আয়োজন করেছিল।

(দ্য রিপোর্ট/ এআই/এজেড/এইচএসএম/এনআই/এপ্রিল ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর