thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মে 24, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৮ শাওয়াল 1445

পোস্টকলোনিয়াল ভাষা ও মধুসূদন

২০১৪ জানুয়ারি ২৫ ০০:২৮:৪৫
পোস্টকলোনিয়াল ভাষা ও মধুসূদন

ড. পাবলো শাহি

মহাকবির ওঙ্কার বঙ্গকবিতাবিদ্যার ধারাবাহিকতা ও অহঙ্কারের সঙ্গে যুক্ত। উহ্যত, এই ধারণা তাঁর কবিতা ও কাব্যভাবনাকে বুঝতে সাহায্য করে একদিকে যেমন অন্যদিকে ‘কলোনি’ বা জবরদখল-এর ইতিবৃত্ত তাঁর পদ ও পদ্যের খোলনোলচেকে দূরাগত পরিবর্তন ঘটায়। ভাষা যেমন ধ্বনির ইউনিটে জাতির মেনোফেস্টকে তুলে ধরে, তেমনি দেশ যদি হয় কলোনির অংশ সে ক্ষেত্রে ভাষার বদল হতে থাকে কলোনি কায়দায়। কেননা, কলোনিয়ালিজম ভাষা সময় অর্থাৎ কালখণ্ডকে প্রভাবিত করে। সে কারণে মহাকবি মধুসূদন ইংরেজি ভাষার কোড ইশারা দখল করে সাম্রাজ্যবাদের মনোভূমির কেন্দ্রে নিজের বোধ-শাখাকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ইংরেজ হবার ইচ্ছা, ইংরেজি ভাষার 'Captive Ladie' লেখা, বঙ্কিমের Rajmohan`s wife উপন্যাসের প্রয়াস, রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা ছেড়ে প্রতীকী ভাষা গ্রহণ-- সেই একই প্রক্রিয়ার ক্রমসম্প্রসারিত (পোস্টকলোনিয়াল ভাষা) রূপ। আর তার পরিণতিতে পঞ্চপাণ্ডবের হাতে এসে দাঁড়ায় ত্রিশ দশকের ক্লিশে কেরানীপদ্য। মূলতঃ বাংলাভাষা, মধুসূদন এবং কলোনিয়ালিজম-- এই তিনটি বিষয়ের একটি যোগসূত্র আছে।

যে কালখণ্ডের পাটাতনে মধুসূদন জীবনকে উচ্চমার্গে উপস্থাপনের কৃৎকৌশল অর্জন করতে চেয়েছিলেন-- তা স্বাভাবিক, কেননা জীবন দখলের জন্য দখলকারীদের সংস্কৃতি আয়ত্ব করা অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করতে চাওয়া মধুসূদনের জন্য অস্বাভাবিক নয়? কিন্তু মহাকবি এই কাজটি করলেন ভারতীয় পুরাণকে ব্যবহার করে। কেননা, তার পোশাক বদল হলেও অন্তরে থেকে গেছে যশোরের খেজুরের রস।

ফলতঃ ঘটল দু’ধরণের ঘটনা। মধুসূদনের কাব্যের শরীর থাকল ভারতীয় কিন্তু চোখ হয়ে উঠল ইউরোপীয়। কনফ্লীক্টের বীজ এখানে উপ্ত (ফিলোসফি ও কনটেন্ট বিভক্ত হয়ে) রইল। সারা জীবনই সেই বীজ তিনি বহন করলেন। বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বেহিশেবী জীবন, হেনিরিয়েটার আত্মত্যাগ, বিদ্যাসাগরের কবির প্রতি সহমর্মিতা-- এভাবেই মহাকবির জীবন মহাকবিতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আর এপিটাফে রচিত হয় সেই বাণী--

‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ট ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে’

অথচ এই কবিই ইউরোপিয়ান হতে গিয়ে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে, ‘ধান গাছে কি তক্তা হয়-- সেই কবিই যখন ফিরল তাঁর প্রীতি প্রণমহি বঙ্গমাতার আঁকুতিতে পূর্ণ হয়ে উঠল।

‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;’

শিল্পের প্রতি তাঁর ডেডিকেশন যেন বীরবাহুর জন্মভূমি রক্ষা হেতু লড়াইয়ের মতো। কেননা, মধুকবি বাংলা কাব্যকে, বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে দিলেন যা, তা পরবর্তীকালে পরিণত হল মেনফেস্টোর মতো; অর্থাৎ আমাদের জীবনে প্রবাহিত হল পোস্টকলোনিয়াল একসেন্ট। মিল্টনীয় সনেট নয় তাই মহাকবি লিখলেন চতুর্দশপদী পদ, আর ডিভাইন অফ কমেডির মতো ব্যাপ্তিতে মেঘনাদবধ কাব্য।

এবে, পুরাণে ঢাকা ভারতীয় কাব্য শরীরে শিল্পচাতুর্যতার চাবিশব্দে তিনি পরালেন ইউরোপীয় রাজ-ঐশ্বর্য। ফলে, ডিরোজীওর হাতে তৈরি তাঁর বিদ্রোহী মন, যা রাবণকে করে তুলল ‘গ্রাণ্ডফেলো’। বাংলার ইসথেটিকসে সে কারণে কলোনিয়ালিজমের প্রবেশ-- ইতিহাস ও জীবনধারার মধ্যে সত্য হয়ে উঠল। তথাকথিত আধুনিকতার কূটবাক্যে পাল্টে গেল ভাব ও ভাবনা, ভাংচুর হল বোধশাখাগুলি, গ্রহণ ও বর্জনে তৈরি হল নোতুন ফিলোসফি অথবা কনফ্লিক্ট। এই ঘেরাটোপে থেকেও মহাকবি, মহান কবি হয়ে উঠলেন। উঠতে হল তাকে জীবন দিয়ে-- বাঙালীকে ও বাংলাকে ভালোবেসে। আর বিনির্মাণ করলেন বাংলা কবিতা ও নাটক যেমন, তাঁর জীবনকেও তেমনি-- এক ঋজু ঐশ্বর্যে। তাই মহাকবির কবিতা ‘ধানের শিষের মতো নতজানু হয়ে’ স্বাগত জানালো না; বরং উদ্ধত হল ভিখারী রাঘবদের প্রতি। আর মহাকাব্যের মহাজীবনের স্বপ্নে বাঙালীকে নেটিভতত্ত্বের বিরুদ্ধে ঘটতকচের মতো ভিমের গদা হাতে দাঁড়াতে শিখাল।

‘দাসেরে রেখ মনে’-- মহাকবির চরিত্র সেই গোড়া থেকে এই প্রত্যয় ও এর বিপরীত কনফ্লিক্ট ছিল? সে জন্য তিনি যেমন প্যারিসের রাস্তায় রাজাকে ফুল দিতে দাঁড়াতে পারেন, তেমনি সচেতনভাবে লেখায় ব্যবহার করলেন না সিপাহী বিদ্রোহীর মতো ঘটনা; তারপরও নীলদর্পন অনুবাদ করে জানি না কোন দায়ভার তিনি মুক্ত হতে চেয়েছিলেন?

পৃথিবীর সকল ঔপনিবেশিক ইতিহাসে দেখা যায়-- দখলদারী দখলকৃত মানুষের ইতিহাসকে জয়পরাজয়ের গর্তে পুঁতে ফেলে। এখানেও তাই হল; ফলতঃ, ভারতের অর্থনীতির ইতিবৃত্ত যার নাম হতে পারত ‘বাৎসায়েনের অর্থশাস্ত্র’ তাকে প্রচার করা হল ‘বাৎসায়নের কামসূত্র’ হিশেবে, পৌরাণিক কাহিনী যা প্রকৃত অর্থে ভারতের ইতিহাস তাকে উপস্থাপন করা হল অপাঠ্যবিদ্যা হিশেবে, পুঁথি সাহিত্যকে নেগলেট করা হল বটতলার সাহিত্য নাম দিয়ে। বাউল, ফোককালচারকে ব্যাগডেটেট বলে উড়িয়ে দেওয়া হল অর্থাৎ কলোনির এক খিচুড়িপাকানো সংস্কৃতি তুলে ধরা হল আমাদের পাতে। এতকিছুর পরও ঔপনিবেশিকতার মধ্যগগণের কালখণ্ডের ফসল মধুসূদন। এইসব ভাষা নির্ণয়ক ও সামূহিক ঐতিহাসিক যতিচি‎হ্নগুলি এড়িয়ে মহাকবিকে চি‎হ্নিত করা যায় না। যায় না তাঁর কবিতার মর্মমূলকে শিকড় গজানো। কাজেই মহাকবির কলোনিয়াল ভাষা-ভাব, বাংলা সাহিত্যের অভিনব শিল্প-নৃবিজ্ঞান এলাকা তৈরি করে? যা থেকে পোস্টকলোনিয়াল ভাষার বীজ এভাবে আমাদের মগজে পুঁতে দেন মহাকবি; আর তিনি সমস্ত ঘটনা-দুর্ঘটনার দুর্বিপাকে-- হয়ে ওঠেন বাংলাসাহিত্যের প্রথম দ্রষ্টা, অদ্বিতীয় সন্ত।

পাবলো শাহি : কবি ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর