thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদের উপন্যাস–বৃদ্ধাশ্রম (পর্ব ১)

২০১৬ অক্টোবর ২৪ ১২:৫১:১৭
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদের উপন্যাস–বৃদ্ধাশ্রম (পর্ব ১)

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভর দুপুর। বৃদ্ধাশ্রমটা যেন শশ্মানপুরি। কোথায় কোন সাড়া-শব্দ নেই। গাছের পাতাও নড়ছে না। যে যার রুমে অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ঘুম নেই শুধু রেহেনার চোখে। নিজের রুমে পায়চারি করছে সে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। অন্যদিন সেও এ সময় ঘুমে আছন্ন থাকে। কিন্তু আজ পারছে না। আজ তার মনটা চঞ্চল। বারবার ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। তাকে তাড়া করে নিয়ে বেডাচ্ছে কাল রাতের স্বপ্নটা। ছেলেকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে।

স্বপ্নের মধ্যে রেহেনা দেখেছে, তার শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে নতুন কাপড় পরে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে ছেলে আজমল। রেহেনা বারবার বারণ করা সত্ত্বেও শুলন না ছেলেটা। সে বায়না ধরেছে দাদা-দাদীর সঙ্গে যাবেই। দাদা-দাদীও তাকে না নিয়ে যাবেন না। বাধ্য হয়েই রেহেনা নিজ হাতে নতুন কাপড় পরিয়ে আজমলকে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের সঙ্গে। নদীর ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা রয়েছে। দাদা-দাদীর সঙ্গে আনন্দে সেই নৌকায় উঠে গেলো ছোট্ট আজমল। মায়ের দিকে সে একবারও ফিরে তাকালো না। মাঝিও যেন খুব অস্থির। যাত্রী ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে নৌকা ছেড়ে দিলো। নৌকা ওপার চলে যাচ্ছে আর এপারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে রেহেনা। হঠাৎ মাঝ নদীতে বিলীন হয়ে যায় নৌকাটা!

স্বপ্নের কথা মনে হতেই রেহেনার চোখের পাতা ভিজে যায়। এমন স্বপ্ন দেখাতো ভালো কথা নয়। মুদ্দারের সঙ্গে চলে যাওয়া অমঙ্গলের লক্ষণ। ছোটবেলায় সে তারা দাদীর কাছে শুনেছে মুদ্দারের সঙ্গে চলে যেতে নেই। এটা অশুভ। বিপদ সংকেত। তাহলে কী তার ছেলেটার কোনো বিপদ হয়েছে! শংকায় বুক কেপে ওঠে রেহেনার। নিজের অজান্তেই সে ফ্লোরে বসে পড়ে। দু’হাত দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে ধরে। ঠিক এ সময় তার ঘরে আসে পরিজান বিবি। রেহেনার পাশে বসে। জানতে চায় কী হয়েছে? এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তার পর স্বপ্নের বিবরণ দেয়। সব শুনে পরিজান বলে, স্বপ্ন স্বপ্নই। এটা নিয়ে ভাবার কোনো কারণ নেই। এতে শান্ত হয় না রেহেনা। তার কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। এবার রেগে যায় পরিজান। বলে যাক না সব উচ্ছন্নে যাক। জাহান্নামে চলে যাক ওরা। যে ছেলে মেয়ে আমাদের কথা ভাবেনি। যারা নিজেদের সামান্য সুখের কথা ভেবে আমাদের এখানে রেখে গেছে তাদের কথা ভেবে লাভ কী! ওরা ধ্বংস হয়ে যাক। তাকে বাঁধা দেয় রেহেনা। নিমিষে তার কান্না উধাও হয়।

এমন করে বলতে নেই বুবু !

কেন বলতে নেই, পরিজানের উত্তর ।

না বুবু। মা বাবা অভিশাপ দিলে তা লেগে যায়। সন্তানের অমঙ্গল হয়।

হোক না, হলে হবে। ওরা আমাদের কিসের ছেলে মেয়ে। যারা শেষ বয়সে বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায়। তারা আমাদের সন্তান নয়। মা-বাবা নেই তাদের। যাদের এতো কষ্ট করে বুকে আগলে রেখেছি। প্রতিটি সেকেন্ড যাদের নিয়ে চিন্তা করেছি তারা কীভাবে পারে এমন করতে। পরিজানের গলা ভারি হয়ে আসে। কথা বলতে কষ্ট হয়। মুখে কাপড় চেপে ঘর থেকে বের হয়ে যায় পরিজান।

বিষয়টা রেহেনার চোখ এড়ায় না। সে পরিজানের কথা ভাবে। পরিজানের তিন ছেলে। সবাই স্বাবলম্বী। যে যার সংসার নিয়ে মেতে আছে। বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের ভরপুর সংসার। অথচ একটা ছেলের কাছেও তাঁর ঠাঁই হয়নি। ছেলেরাই তাকে এখানে রেখে গেছে। তিনটা ছেলে অথচ তার মার এ অবস্থা। রেহেনার একটা প্রবাদ মনে পড়ে, এক পুতির মা ঠাকুরণী দশ পুতির মা কুকুরণী। যার অর্থ এক ছেলে হলে তার কোনো টেনশন নেই। মাকে সে কখনো ফেলে দেবে না। পক্ষান্তরে যে মায়ের বেশি ছেলে আছে, তার কষ্টের সীমা থাকে না। এ প্রবাদটি ইদানিং খুব বেশি মিথ্যা মনে হয় রেহেনার। কী দাম আছে এ প্রবাদের! তারতো একটাই ছেলে। কই সে তো মাকে কাছে রাখতে পারেনি! নিজের সংসারের শান্তির জন্য মাকে বিসর্জন দিতে একটু সময় লাগেনি তার। রেহেনা ভাবে আসলে ১০ ছেলে আর এক ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য মানসিকতায়। মনু্ষ্যত্ব ঘুমিয়ে থাকলে সেই মানুষ পারে না এমন কিছু নেই।

রেহেনা কখনো ভাবেনি তার ছেলেটা কখনো এমন হবে। কাল রাতে যে পিচ্চি ছেলেটাকে সে স্বপ্নে দেখেছিলো সেই ছেলেটার আজ ৩৯ বছর বয়স। রেহেনার সামনে আজমলের সেই কচিমুখটা ভেসে ওঠে। কী এক নিষ্পাপ মুখ। ছেলেটা সারাক্ষণ তার পিছে পিছে থাকত। বাবা অনেক আদর করেও তাকে কাছে নিতে পারত না। রেহেনার স্বামী রাজ্জাক প্রায়ই বলত ছেলেটা আসলে তোমার, আমার নয়। মা ভক্ত হয়েছে। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুনসুটি হতো।

একবার রেহেনার জ্বর হয়েছিলো। সেই সময় আজমল সারাক্ষণ মায়ের পাশে বসে থাকত। বাবার কাছে বারবার জানতে চাইত কবে ভালো হবে তার। একদিন রেহেনা তাকে বলেছিলো। আমি যদি আর ভালো না হই। মরে যাই! তাহলে কী করবি তুই। অন্য একজনকে মা ডাকতে পারবি? উত্তরে আজমল বলেছিলো তুমি মরে গেলে আমি মরে যাব। অন্য কাউকে মা ডাকতে পাবর না কখনো। বড় হয়েও ছেলেটা আগের মতোই ছিলো। মা ছাড়া কিছুই বুঝত না সে। রেহেনার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আজমলও তার থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করল। মগ্ন হয়ে গেলো নিজের সংসার নিয়ে। এতে দুঃখ ছিলো না রেহেনার। ছেলে বিয়ে করার পর তার আলাদা একটা ভুবন হবে এটাই স্বাভাবিক। এটা মেনে নিয়েছিলো রেহেনা। কিন্তু কখনো ভাবেনি ছেলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাবে। যেটা সে কখনো ভাবেনি সেটােই ঘটেছে তার জীবনে। সম্ভবত এটাই বাস্তব। জীবন কাকে কখন কোথায় নিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারে না। রেহেনা ভাবে মানুষকে সব সময় যে কোনো পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকা উচিত।

উপন্যাস : মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

প্রচ্ছদ : জাহেদুর রহমান রবিন

চলবে….( প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে এ উপন্যাসটি)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর