thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৮ এপ্রিল 24, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৯ শাওয়াল 1445

ঢাবিতে ওড়ে তিন রঙের স্বাধীন বাংলার পতাকা

২০১৬ মার্চ ০২ ০০:০৮:৫২
ঢাবিতে ওড়ে তিন রঙের স্বাধীন বাংলার পতাকা

একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তথা এ অঞ্চলের জনগণের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ও পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চে। ঘটনাবহুল মার্চ তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবছর মার্চ এলেই আমরা ফিরে যাই ’৭১-এর সেই অগ্নিঝরা ও রক্তঝরা দিনগুলোতে। নিছক স্মৃতিকাতরতা নয়, মার্চ হোক আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ’৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত দিনলিপি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

০২ মার্চ, ১৯৭১

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, কল-কারখানা কার্যত: বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী এদিন ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। শহরের সকল দোকানপাট ও কলকারখানা বন্ধ ছিল। কর্মচারীরা কেউই কাজে যোগ দেয়নি, অফিস-আদালত সর্বত্র বিরাজ করছিল এক ধরনের স্তব্ধতা।

এদিন বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশে মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ ও সোনালী তিন রঙের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আর এ পতাকার পরিকল্পনা ও নকশা করেছিলেন শিল্পী শিব নারায়ণ দাস। ঐতিহাসিক এ সমাবেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয়েও পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।

বিকেলে পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় অনির্ধারিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সমাবেশেই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের ঢল। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ করার পাশাপাশি ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ এ ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়।

এদিন আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে ঢাকায় কারফিউ জারি করে পাকিস্তান সরকার। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে ছাত্ররা ও শ্রমিক এলাকা থেকে শ্রমিকরা ‘সান্ধ্য আইন মানি না’ বলে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়া জনতার কাছে পরাজিত হয় কারফিউ। এ সময় শহরের বিভিন্ন স্থানে কারভিউ ভেঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাস্তার উপর ব্যারিকেড দেয়।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডিআইটি এভিনিউ (বর্তমানে রাজউক এভিনিউ) মোড়, মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনেসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কারফিউ ভঙ্গকারী ও বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। মানুষের বিশাল মিছিল কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এ সময় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে বুলেটবিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। একদিকে লাশের সারি, অন্যদিকে কান্নার মিছিল। এদিন রাতে পাক সেনাদের গুলিতে শুধু ঢাকাতেই ২৩ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয় বলে পরে জানা যায়। শহীদদের লাশ নিয়ে রাতেই ইকবাল হল থেকে শোভাযাত্রা ও কয়েকটি খন্ড খন্ড মিছিল বের করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শোক মিছিল করে শহীদ মিনারে এসে জমায়েত হন।

এদিন ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করা হয়। এ আদেশ বলে পত্রপত্রিকাসমূহে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা স্থিরচিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি ও কর্মসূচী

এদিন রাতে এক বিবৃতিতে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বালাবেন না। যদি জ্বালান, সে দাবানল হতে আপনারাও রেহাই পাবেন না।… সাবধান, শক্তি দিয়ে জনগণকে মোকাবেলা করবে না। … নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণ গণহত্যারই শামিল এবং তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।’

এর আগে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যারা শক্তির দ্বারা জনগণের মোকাবেলা করতে চান তাদের এ ধরনের বেপরোয়া পথ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। বাঙালিরা আর নির্যাতিত হতে রাজী নয়।বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

এদিন ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল এবং ৩ মার্চ শোক দিবস পালনের কর্মসূচী দেন তিনি।

ভুট্টোর সংবাদ সম্মেলন

এদিকে পূর্ব বাংলা যখন বিক্ষোভে ও প্রতিবাদে উত্তাল তখন পশ্চিম পাকিস্তানে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘বর্তমান সঙ্কট আয়ত্তের বাইরে চলে যায়নি। … জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখায় নিশ্চিতভাবে কিছুই ক্ষতি হয়নি। পরিষদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়নি। অধিবেশন স্থগিত রাখায় প্রধান দুটি দল এক সঙ্গে বসার ও সমঝোতায় উপনীত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে। শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাদের সময় প্রয়োজন।’

শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে তিনি মোটেই উদাসীন নন বলেও জানান ভুট্টো।

তবে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে তার ‘দলের ভূমিকার কোন পরিবর্তন হয়নি’ এমন মন্তব্য করে সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো আরও বলেন, ‘প্রধান দুটি দলকে বর্তমান সঙ্কট ও শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা নিরসনের চেষ্টা করতে হবে। দেশের দুটি প্রধান দল শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে কিছুটা সমঝোতায় পোঁছা মাত্রই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারে। … সত্যিকার ফেডারেশনে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হওয়া উচিত। পিপলস পার্টি আপসহীন মনোভাব গ্রহণ করেনি।’

এদিন সন্ধ্যায় করাচীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। পিপলস পার্টি ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ভুট্টোর ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি আগামী ৫দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বানের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিল লীগ নেতা এয়ার মার্শাল (অব) নূর খান মার্চের মধ্যেই জাতীয় গণপরিষদ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘জাতীয় পরিষদ স্থগিত করায় যে ক্ষতি হয়ে গেল –তা অত্যন্ত ব্যাপক এবং অবিলম্বে অধিবেশন আহ্বান না করলে এ ক্ষতি সংশোধনের অতীত হয়ে পড়বে।’

গ্রন্থনা : সোহেল রহমান

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/মার্চ ০২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর