thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মে 24, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৮ শাওয়াল 1445

খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলীর সাক্ষাৎকার

‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, সার্টিফিকেট বা আইডি কার্ডের জন্য নয়’

২০১৬ ডিসেম্বর ১২ ২০:২০:৫৮
‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, সার্টিফিকেট বা আইডি কার্ডের জন্য নয়’

বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলী। বর্তমানে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ১৯৭১ সালে খুলনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। একই সময় তিনি ছিলেন খুলনার বিএল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি। সে সময়ের টগবগে তরুণ ছাত্রনেতা বাবর আলী স্বাধীনতাযুদ্ধে ৯নং সেক্টরে আঞ্চলিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের দেরাদুনে জেনারেল ওভানের নেতৃত্বে সামরিক প্রশিক্ষণ, বিশেষ করে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও খুলনা শত্রুমুক্ত হয়েছিল এর এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর শহীদ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সাতক্ষীরার অসংখ্য যুদ্ধের মধ্য দেবহাটার টাউন শ্রীপুরের যুদ্ধের কথা উল্লেখযোগ্য। এ রক্তক্ষয়ী যদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাবর আলী। মুক্তিযুদ্ধে তিনি আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন। তাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে স.ম. বাবর আলী ‘স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান’ নামক একটি বইও লিখেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯১ সালের বিজয় দিবসে।

স.ম. বাবর আলী বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রশসান থেকে বারবার ফরম ফিলাপ করার কথা বলা হলেও আমি কিছুই করিনি। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, কোনো সার্টিফিকেট বা আইডি কার্ড পাবার জন্য নয়।’

গত ১০ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলীর সাক্ষাৎকার নেন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের খুলনা ব্যুরো প্রধান মুহাম্মদ আবু তৈয়ব। খুলনার ৫৩ হাজী মুহাসিন রোডের নিজ বাসভবনে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে স.ম. বাবর আলী বলেন, তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমার দেবহাটা থানার ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত টাউন শ্রীপুর গ্রাম। এই নদী ভারত আর বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে। এই গ্রামে পাক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কাছে অভিযোগ জানায়। তারপরই সিদ্ধান্ত হয়, পাক বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালানো হবে। ১৯৭১ সালের ৬ জুন রাতে আমরা নদী পার হয়ে এলাকাটিতে প্রবেশ করি। মোট তিনটি গ্রুপ হয়, আমার অধীনে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। রাতেই তিন গ্রুপ তিনদিকে চলে যায়। এলাকাটি আমাদের গ্রুপে থাকা শাহজাহান মাস্টারের হওয়ায় রেকি করার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত হয়। মাঝরাতের দিকে আমরা সেই গ্রামের পাক বাহিনীর ক্যাম্পে বিনা বাধায় প্রবেশ করি। পরে জানতে পারি, পাক বাহিনী রাতে এলাকায় থাকে না। তারা দিনে আসে এবং সন্ধ্যার পর থানা সদরে চলে যায়। সেখানে তখন শাহজাহান মাস্টারসহ সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় রাতে গ্রামে বিশ্রাম করে সকালে নাস্তার পর অভিযান চালানো হবে। কিন্তু আমার ধারণা, মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থানের খবর ফাঁস হয়ে যায়। এই কারণে আমার সহযোগী যোদ্ধারা পরদিন সকালে যখন ঘুমিয়ে আছে, ঠিক তখনই পাক সেনারা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমি প্রথম পাক সেনাদের আসতে দেখে সহযোগীদের ঘুম থেকে উঠিয়ে অস্ত্র হাতে নিতে বলি। বাইরে তাকিয়ে দেখি একজন পাক সেনা সেই বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে, তারা সম্ভবত বুঝতে পারেনি যে এই ঘরের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে।

ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে স.ম. বাবর আলী বলেন, পাক সেনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। পাক সেনা অস্ত্রসহ লুটিয়ে পড়ে। সবাই নিজ নিজ অস্ত্র হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। আমিও ঘর বেড়িয়ে থেকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে নেমে পড়ি। ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি নালা (ড্রেন) দেখতে পাই। সম্ভববত সেটি পানি তোলার ড্রেন ছিল। বেশ গভীর, তবে দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় ওপরে লতাপাতায় ঢেকে গিয়েছিল। এসএমজি, একটি রাইফেল আর দুইটি গ্রেনেড নিয়ে আমি সেই নালায় নেমে পড়ি। ধীরে ধীরে ড্রেনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হই। হাত দশেক যাওয়ার পর দেখি এক পাক সেনা বিপরীত দিকে অস্ত্র তাক করে গাছের আড়ালে লেপটে রয়েছে। আমি রাইফেলের ট্রিগার টিপতেই মুহূর্তের মধ্যে সে লুটিয়ে পড়ে। সেবারই প্রথম আমি পাক সেনা হত্যা করেছিলাম। সেই সময় আমার মৃত্যু ভয় ছিল না। রোমাঞ্চিত হয়ে ধীর গতিতে অগ্রসর হতে শুরু করি। বিশ-পঁচিশ হাত অগ্রসর হওয়ার পর দেখলাম, দুই পাক সেনা মাটিতে শুয়ে তার দিকেই অস্ত্র তাক করে রয়েছে। তবে তারা বুঝতে পারছে না যে আমি এই ড্রেনের মধ্যে রয়েছি। তবে শব্দ হলেই তারা দেখতে পারে। আমার অবস্থান এমন এক জায়গায় যে আগে গুলি করতে পারবে সেই বাঁচবে। কালবিলম্ব না করে আমি গুলি করি, তাতে একজন নিহত এবং অপরজন গড়িয়ে গড়িয়ে যাওয়ার সময় তাকেও হত্যা করি। তারপর আবারও দুই পক্ষের তুমুল গুলিবর্ষণ হয়। ইতিমধ্যে আমার গুলি প্রায় শেষ শুধু রাইফেলে দুটি গুলি ছিল। এই অবস্থায় আমি সেই নালার দিয়ে অগ্রসর হতে হতে নদীর তীরে চলে আসি। পরে ইছামতী নদী সাঁতরে ভারতে প্রবেশ করি। আমার চোখে মুখে তখন আগুন, সহযোগীদের খোঁজ নেই।

ক্যাম্প থেকে গুলি নিয়ে আবার রওনা হবার মুহূর্তে আমাকে আটকে রাখা হলো। তখন আমি চিৎকার করে বলি, ‘আমদের সবাই ঘেরাও হয়ে যায়, আমার গুলি নাই, গুলি দাও, আমি ওপারে যাবো।’

এই সময় গফুর ভাই, ডা. আসিকুর রহমানসহ পরিচিতরা আমাকে একটি ঘরে বিশ্রাম নিতে বলে। পরে আমি সেই ঘরের জানালা ভেঙে কামরুজ্জামান আর বিলুকে সঙ্গে নিয়ে নদী পার হয়ে আবারও যুদ্ধ ময়দানে যাই। সঙ্গে গুলি নিয়ে যাই। ওই সময় যুদ্ধের তীব্রতা কমে গেছে। দেহের বিভিন্ন স্থানে ৩১টি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সহযোদ্ধা হাবলুকে উদ্ধার করি। তাকে উদ্ধার করে ভারতীয় সেনা চিকিৎসক দলের কাছে নিয়ে গেলে হাবলুর দেহে অস্ত্রোপচার করে ৩১টি গুলি বের করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অবাক করে দিয়ে হাবলু সেই সময় বেঁচে যায়। সেই যুদ্ধে সাতক্ষীরার কাজল আর নাজমুলের লাশ পাওয়া যায়নি, আরও নিখোঁজ ছিল কয়েকজন। তবে আমরা ২১ পাক সেনার লাশ ফেলে তাদের অস্ত্র নিয়ে আবার টাকি ক্যাম্পে গিয়ে মেজর জলিলের কাছে রিপোর্ট করি। গেরিলাযুদ্ধ যাকে বলে এই টাউন শ্রীপুরে সেই যুদ্ধই হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ হতে কপিলমুনি ক্যাম্পে রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। তিন দিন যুদ্ধের পর সেই ক্যাম্প হতে ১৫৪ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আটক করা হয়। পরে সেখানেই গণ-আদালত বসিয়ে ৯ ডিসেম্বর ১৫৪ জন রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

তারপর আমার নেতৃত্বে কামরুজ্জামান টুকু, রহমতউল্লাহ দাদু, ইউনুস আলীকে সঙ্গে নিয়ে খুলনা শহর অভিমুখে রওনা হই। কিন্তু পাকবাহিনী খুলনা শিপইয়ার্ড, লায়ন্স স্কুল, শিরোমনিতে শক্ত প্রতিরোধ করে তোলে। এর মধ্যে শিরোমনির যুদ্ধ সব থেকে স্মরণীয় এবং আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিরোমনি যুদ্ধ সব থেকে আলোচিত। এখানে আকাশ, কামানসহ সব ধরনের যুদ্ধের পর ব্যানেট যুদ্ধ হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকবাহিনী আত্নসমর্পণের পরও খুলনায় যুদ্ধ চলছিল। এই সেক্টরের মিত্রবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল দলবীর সিং, নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন হুদা, ডা. শাহজাহান খুলনা মুক্ত করার পরিকল্পনা আটছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে খুলনা অঞ্চলের পাক বাহিনী প্রধান বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান আত্মসমর্পণ করবেন বলে বার্তা পাঠান। মিত্রবাহিনীর কাছে আসেন ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানসহ সাত কর্নেল।

পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল খুলনা নিউজপ্রিন্ট। সেখানে প্রথম পাকবাহিনী অস্ত্র জমা দিয়ে মিত্রবাহিনী প্রধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে ১৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে অাত্মসমর্পণ করে। এ সময় সার্কিট হাউস ময়দায়ে প্রথম বাংলাদেশি পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমতউল্লা দাদু আর খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে পতাকা উত্তোলন করি আমি।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর