thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মে 24, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৮ শাওয়াল 1445

‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বীকৃতি নিয়েই মরতে চাই’

২০১৬ ডিসেম্বর ১৫ ১০:৫৬:৪২
‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বীকৃতি নিয়েই মরতে চাই’

সাইফুল ইসলাম শিল্পী, চট্টগ্রাম : জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সুজিত নাগ। বাবা মনমোহন নাগ ও মা সুষমা নাগের ৬ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে ছোট সন্তান তিনি।

এ মুক্তিযোদ্ধার দুই ছেলে পীযূষ নাগ ও মিথুন নাগ। বড় ছেলে মিথুন ভারতের বেলুড় মঠে আছে। ছোট ছেলে পীযূষ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে মারা যায় স্ত্রী। এরপর একা হয়ে পড়েন তিনি।

মা-মাটির স্মৃতি বিজড়িত এ গ্রাম ছেড়ে তিনি যাননি আর কোথাও। ছেলেরা শহরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। যাননি, যেতে পারেননি শেকড়ের টানে।

বিজয়ের মাসে যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি বলেন, ১৯৭১ সাল। বয়স তখন ২৬। দেশ উত্তাল, পাকিস্তানী সৈন্যরা একের পর এক বর্বরতা শুরু করেছে, নিরীহ মানুষ মারছে, মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করছে। সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাব। কুমিল্লা হয়ে ভারতে চলে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নিই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল। বোয়ালখালীতে তখন সার্কেল অফিসার ছিলেন এনামুল হক। এ সময় বহু নির্যাতন করা হয় আমার ওপর। নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। সেখান থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী উদ্ধার করেন। এরপরও স্বাধীন দেশে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে বহুবার। তিনবার জেল খেটেছি।

মুক্তিযোদ্ধা সুজিত নাগ বলেন, স্বাধীনতার পর এক বান্ডেল টিনও পাইনি, পাইনি কোনো সরকারি সুবিধা। বর্তমানে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছি। এতেই আমার দিন চলে যায়।

তিনি বলেন, খারাপ লাগে তখন, যখন দেখি ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তারা আজ মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি ভাতা তুলছে। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও ভয় লাগে, কেন না তারা সংখ্যায় বেশি। স্বাধীনতার পরে দেশে এসে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন।

তিনি বলেন, নিজের মুক্তিই হয়নি, কিভাবে দেশের মুক্তির কথা বলব। ঘৃণা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যখন দিনমজুরি করছে। সারোয়াতলীর জাফর, ভুপাল পারিয়াল, বিমল দে, পুলিন দাশ ধনা, অনন্ত বিশ্বাসসহ অনেকে অন্ধ হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। তাদের বউ ছেলে-মেয়েরা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। তাদের পক্ষে সম্ভব না মন্ত্রণালয়ে যাওয়া, ২০ হাজার টাকা দিয়ে সনদ নেওয়া। এমন ঘটনাও ঘটেছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে সনদ পেতে ঢাকায় গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।

যখন সরকার ভাতা দেয়নি তখন কি মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেতে কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছিল, না। তখন মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কতছিল, আজ কত? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তিনি বলেন, দেশের মাটিকে রক্ষা করা, দেশের নাগরিকের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব বোধের কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কোনো সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধে যাইনি। অথচ আজ ভুয়ারা শত শত সার্টিফিকেট নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

শাস্তির বিধান রেখে যদি মুক্তিযোদ্ধা দাবিদারদের যাচাই বাছাই করা হয়, দেখবেন অনেকে পালিয়ে যাবে। সরকারের টাকা যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে, তাতে আমার কি। তবে খারাপ লাগে তখন, যখন মনে প্রশ্ন জাগে এসব চোরদের জন্য কি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন করেছিলাম?

মরার জন্যই যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বাঘের মতো বার বছর বাঁচায় অনেক আনন্দ। কুকুরের মতো বহু বছর বেঁচে থেকে লাভ কি বলো, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

জীবনে কোনো খারাপ কাজ করিনি। সৎ ছিলাম বলেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কারো কাছে হাত পাতিনি। কেননা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তা পারিনি, আত্মমর্যাদার জন্য।

সারোয়াতলীতে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের নিয়ে বোয়ালখালীর প্রথম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিলাম। এ স্মৃতিসৌধে শহীদ ভবন করার স্বপ্নে নাম দিয়েছিলাম শহীদ ভবন। এর জন্য স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহিম প্রায় ৫০ শতক জায়গা দিয়েছিলেন। মনে বেদনা রয়ে গেছে, ভবনটি আজো করা সম্ভব হয়নি।

এখন পড়ন্ত বেলায় এসে গেছি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তা নিয়ে মরতে চাই এ মাটির বুকেই।

(দ্য রিপোর্ট/এইচ/এআরই/এনআই/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর