thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২৩ জমাদিউল আউয়াল 1446

অবশেষে একুশে ফেব্রুয়ারি

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২১ ০৬:৫৬:১২
অবশেষে একুশে ফেব্রুয়ারি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ। বসন্তের দ্বিতীয় সপ্তাহ চললেও শীত তখনও জেঁকে বসে আছে। সেই শীতে ছাত্রদের মধ্যে সকাল থেকে টান টান উত্তেজনা। তাদের অনেকে সারারাত ঘুমাননি। একটু রোদ উঠতে না উঠতে ছাত্রদের আনাগোনা বেড়ে যায় মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সকাল ৯টা থেকে জমায়েত শুরু হয়। এর মধ্যে গেটের বাইরে রাস্তায় ছিল খাকি হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ বাহিনীর সর্তক অবস্থান। তাদের কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে অস্ত্র। পাশে দাঁড়ানো জিপগাড়ি ও ট্রাক। অর্থাৎ যে কোনো ঘটনা মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত।

যেখানে এখন মেডিক্যালের ইমার্জেন্সি, যেখানে তখন ছিল আর্টস বিল্ডিং। তার গেটের কাছে বড়সড় আমগাছ। সকাল ১১টায় আমতলায় সভা হয়। উপস্থিত ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখ। সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, হেদায়েত হোসেন চৌধুরীসহ অনেকে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ না করার পক্ষে থাকেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হোসেইনের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশস্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।

উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। আব্দুল মতিন বলেন, ‘এ মুহূর্তে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে না গেলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে, ভাষার দাবি কোনো দিনই অর্জিত হবে না।’ ঠিক হয় ১০ জনে ছোট ছোট মিছিল করে ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে। লক্ষ্য অ্যাসেম্বলি হল। আপাত গন্তব্য কাছাকাছি অবস্থিত মেডিক্যাল ব্যারাক প্রাঙ্গণ।

সভায় আবদুস সামাদসহ অনেকজন ছাত্রনেতা সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। সভাপতি গাজীউল হকের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সভা শেষ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে স্লোগান ভেসে আসে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’. ‘চলো চলো, অ্যাসেম্বলি চলো’ ইত্যাদি। সভা শেষ হতে না হতে ১০ জন করে ছাত্রছাত্রী মিছিল নিয়ে বেরুতে থাকে। তখনই শুরু হয় পুলিশী অ্যাকশান।

পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং মিছিলকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। পুলিশ সে দিন অনেককে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ, হাবীবুর রহমান শেলী, আলী আজমল ও আনোয়ারুল হক প্রমুখ। যে সব ছাত্রী মিছিলে অংশ নেন তাদের মধ্যে ছিলেন শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহিম ও শামসুন্নাহার প্রমুখ। রওশন আরা বাচ্চু লাঠিচার্জে সামান্য আহত হলেও পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

শেষ পর্যন্ত অনেক ছাত্র পুলিশের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করে ব্যারাক প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেয়। আমতলা থেকে ব্যারাক প্রাঙ্গণে পৌছে তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠে অ্যাসেম্বলি ঘেরা্ও। আরও লক্ষ্য ছিল রাস্তা থেকে এমএলও কাউকে না কাউকে আটক করে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব তোলার প্রতিশ্রুতি আদায়। তারা রাস্তা থেকে মানিকগঞ্জের এমএলও আওলাদ হোসেনকে হোস্টেলে নিয়ে আসে। তাকে দাবির কথা জানায়। তিনি কথা দিয়ে মুক্তি পান। এ রকম আরও কিছু ঘটনা ঘটে।

বিকেল ৩টার দিকে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। সরকারি হিসেব মতে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ২৭ রাউন্ড গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আবুল বরকতের উরুতে গুলি লাগে। অস্ত্রপচার করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র নাথ কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক শহীদ হন। গফরগাঁওয়ের কৃষকযুবা আবদুল জব্বার মেডিক্যালে এসেছিলেন রোগীর দেখাশোনা করতে। ইমার্জেন্সিতে নিতে নিতে তিনি শহীদ হন। পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায়। কেউ কেউ বলেন আরও দুই-একজন সে দিন শহীদ হয়েছিলেন। পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘণ্টাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয়।

বিকেলের মধ্যে ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে। গুলিবর্ষণের সংবাদ আইন পরিষদে পৌঁছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস ও শামসুদ্দিন আহমেদসহ পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবি করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাওয়ার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন। সরকারি দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ শরফুদ্দিন আহমেদ, সামশুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মসলেউদ্দিন আহমেদ এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ হন কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন। রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হওয়ার আহ্বান সম্বলিত লিফলেট বিলি করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজে শহীদদের জানাজা হয়। জানাজার পরে বিক্ষোভ মিছিল হয়।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

অমর একুশে গ্রন্থমেলা এর সর্বশেষ খবর

অমর একুশে গ্রন্থমেলা - এর সব খবর